বিদ্যাসাগর চরিত্র নির্মাণঃ তাঁর
যাপিত কালের প্রেক্ষিতে
ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের একজন সমাজসংস্কারক ও পন্ডিত মানুষ। তাঁর জন্ম ও যাবতীয় কর্ম-সবই উনিশ শতকের মধ্যেই ঘটেছিল। উনিশ
শতকের পন্ডিতেরা এযুগকে নবজাগরণের যুগ বা নবচেতনার যুগ বা কখনও নবজিজ্ঞাসার যুগ
বলে চিহ্নিত করেন। ১৮২৯ সালে বেঙ্গল
হেরাল্ড পত্রিকায় এই যুগকে বলা হয়েছিল “dawn of a new era”
। বলাবাহুল্য এই নবজাগরণ বা নবচেতনা এসেছিল
ঔপনিবেশিক সংস্পর্শে। তাই কেউ কেউ মনে করেন,উনিশ শতকের আলোকায়ন শুধুমাত্র নগর
কলকাতাকে কেন্দ্র করে বা সাহেবদের আনুগত্যে যারা ছিল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিংবা
মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায় একমাত্র এর
সুফল ভোগ করেছিল। বাঙালি মনন ও চেতনায় কীভাবে উপনিবেশবাদের ছায়া মিশে ছিল তার কথাও
সমালোচকেরা বলেন। একদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহেবদের রাজনৈতিক নানা কৌশল যেমন
একশ্রেণির মানুষকে সুবিধা দিয়েছিল তেমনি এই সময়ে স্বদেশকে নতুনভাবে চেনা , নানা
সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন, রাজনৈতিক চেতনার বীজ উন্মেষের সূত্রপাতও ঘটে। তাই এই সময়ে নানা দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তি
পরিলক্ষিত হয়। এই দ্বন্দ্বময় আবহে নির্মিত হয়েছিল আমাদের উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ
চরিত্রগুলি। বিদ্যাসাগরও এমন একটি চরিত্র।যাঁর চরিত্র সমকাল নির্মাণ করেছিল। তাঁর
চরিত্রকে নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত উঠে আসে।
এই মতামতে তিনি যেমন একদিকে মহামানব,অন্যদিকে তাঁর নানা মানসিক দুর্বলতায় ভীরু
বাঙালি, অন্তর্দৃষ্টিহীন সমাজসংস্কারক, সকলের সঙ্গে মিশতে না পারা নিঃসঙ্গ পুরুষ। তাঁর
চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি সম্পর্কে কবি উৎপল কুমার বসুর “সুখে থাকো বিদ্যাসাগর
চিরজীবী হয়ে”নামক প্রবন্ধে একটি মন্তব্যকে উল্লেখ করা যেতে পারেঃ “ বিদ্যাসাগর
মশায়কে নিয়ে আমাদের সমস্যার শেষ নেই। মৃত্যুর একশো বছর পরেও আমরা স্থির করে উঠতে
পারিনি তিনি রক্ষণশীল না প্রগতিপন্থী,বস্তুবাদী না ভাববাদী,মানুষ না দেবতা।
প্রতিভা হয়তো মানব সমাজে বিরল নয় কিন্তু তার চিহ্নিত হতে সময় লাগে এবং তার চরিত্রবিচার কালসাপেক্ষ।এই সুযোগে তৈরি
হয় ভক্তের কাল্পনিক গল্প,আরোপিত গুণ এবং আকাঙ্ক্ষিত মনোবাসনা।” আমরা
আমাদের আলোচনাতে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর নয়,সমকাল কীভাবে বিদ্যাসাগর চরিত্রটিকে
নির্মাণ করেছিল সেদিকেই লক্ষ রাখার চেষ্টা করব।
হুগলী জেলার
বনমালীপুর গ্রামে ভুবনেশ্বর বন্দ্যোপাধায় ছিলেন একজন সংস্কৃত পন্ডিত।তাঁর
পাঁচপুত্রের মধ্যে রামজয় বন্দ্যোপাধায়ের পুত্র ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় । রামজয় দুই পুত্র ও চার কন্যা ছেড়ে কাউকে কিছু না
বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যান। তাই তাঁর
অসহায় পত্নী দুর্গাদেবী বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি বীরসিংহা গ্রামে আসেন। এখানেই তাঁরা আজীবন থাকেন।এখানে এসে ঠাকুরদাসের মাতামহ যতদিন
বেঁচেছিলেন ততদিন তাদের কোনো অভাব না ঘটলেও তাঁর মৃত্যুর পর দুর্গাদেবী চরকা ক্রয়
করে সুতা কেটে দিনযাপন করতে থাকেন।তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তারপর
পাঁচবছর পর রামজয় বিদেশ থেকে ফিরে এলে পুত্র ঠাকুরদাসকে উপার্জনের জন্য কলকাতাতে
নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি কোনোরকমে ইংরেজি শিক্ষা শিখে,অত্যন্ত কষ্ট ও দারিদ্রতার
সঙ্গে লড়াই করে সামান্য চাকুরি পান।
বিদ্যাসগর চরিত্রটি নির্মাণের পিছনে এই প্রেক্ষিতটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। বিনয় ঘোষ
তাঁর “বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা”
গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক প্রভাবে গ্রাম্যসমাজ পরিবর্তনের গতি নির্ধারিত
হয়েছিল। এই গ্রাম্যসমাজের পরিবর্তনের ফলেই ঠাকুরদাসকে বাধ্য হয়ে কলকাতামুখী হতে
হয়েছিল। চিরাচরিত বাংলার গ্রাম্যসমাজের যে গঠন ছিল সেই গঠনে সেখানে আর্থপ্রভাব খুব
একটা প্রাধান্য ছিল না,মূলত ছিল কৌলিক প্রভাব। ঠাকুরদাসের মাতার ক্ষেত্রে দেখা যায়
সেই কৌলিক প্রভাব থেকে তিনি বঞ্চিত হন এবং তাঁকে চরকা কাটতে হয়ঃ “তৎকালে বিলাতি
সূতার আমদানি হয় নাই; এ প্রদেশের নিরুপায় অনেক স্ত্রীলোকেই সূতা প্রস্তুত
করিয়া,তাহা বিক্রয় করিয়া কষ্টেসৃষ্টে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিত। আত্মীয়বর্গের উপদেশানুসারে দুর্গাদেবীও অগত্যা
একটি চরকা ক্রয় করিয়া সূতা কাটিতেন...” উনিশ শতকে বাঙালির
কারুশিল্পের এমন অধঃপতন ঘটে যে তা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি কখনও। তার উপর নতুন
জমিদারী প্রথা। সেখানে সাধারণ প্রজার সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক ছিল খাজনা দেওয়া
টুকুই। কলকাতা নগর গড়ে ওঠার আগে বহু শিল্পনগর ছিল,সাহেবদের নব শিল্পায়ন নীতিতে সেই
নগরগুলিও ধুঁকতে থাকে। সেই শিল্পনগরগুলির জনসংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে “ইংরেজ শাসনে
বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশীয় শিল্পের ক্রমিক অবক্ষয় বিদ্যাসাগর চোখের সামনেই
দেখেছিলেন। ... বীরসিংহের নিকটবর্তী খড়ার ছিল কাঁসা পিতল শিল্পের একটি বড়ো উৎপাদন।
...... ঘাটালে বিদ্যাসাগরের জন্মকালে অন্তত দুটি বিদেশি কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়
ছিল,যারা রেশম ও রেশমের কাপড় কিনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করত” শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিদ্যাসাগরের
জীবনীতে জানিয়েছিলেন,তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিছুদিন রেশম ও সূতী
বস্ত্রের ব্যবসা করেছিলেন।কিন্তু ব্যর্থ
হয়ে তিনি আবার কলকাতামুখী হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর এমনই এক পরিবারের সন্তান যাদের না
ছিল জমিজমা,না ছিল ব্যবসা।তবে সংস্কৃত বিদ্যার গরিমা তাঁর পরিবারের ছিল-পিতা ও
মাতা দুই দিক থেকেই। কিন্তু দারিদ্রতা ও যুগের সাঁড়াশি চাপে তাঁর পিতা সংস্কৃত
ছেড়ে ইংরেজ শিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন উপার্জনের তাগিদে- “এক্ষণে ঠাকুরদাসের
বয়ঃক্রম চতুর্দশ বৎসর অতীতপ্রায়;পড়াশুনা অধিক দিন করিলে সংসার চলা
দুষ্কর।আত্মীয়বর্গ এই উপদেশ দেন যে, সংস্কৃত অধ্যয়ন বন্ধ করিয়া,যাহাতে শীঘ্র
উপার্জন করিতে সক্ষম হন,এরূপ বিদ্যাশিক্ষা করা অত্যাবশ্যক।” তবু সংস্কৃতের প্রতি তাঁর পারিবারিক ভালোবাসা ও আবেগ লক্ষ করা যায়। তাই তাঁদের মতো পরিবারের
কাছে একমাত্র চাকুরি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। বিদ্যাসাগরও সেই পথেই এগিয়ে
ছিল।জীবিকার জন্যও তাকে যেতে হয়েছিল কলকাতা। সেখানে পড়াশোনা শিখে পরিবারের সম্বল
হবে। মেধাবী ছাত্র বিদ্যাসাগর। গ্রামে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা শেষ করে
পন্ডিতমশায় উপদেশ দেয় তাঁকে যেন কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেও ইংরেজি শিক্ষার
জন্যঃ “ঈশ্বরকে এখান হইতে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হইয়াছে।আপনি নিকটে
রাখিয়া ইংরাজী শিক্ষা দিলে ভালো হয়” সেই সময় কলকাতায় নানা রকম ইংরেজি স্কুল
হয়েছিল। কিন্তু ঠাকুরদাস ছেলেকে সংস্কৃত কলেজেই ভর্তি করার মনস্থ করেন। তাঁর
স্বপ্ন ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন পিতার মতোঃ “কয়েকদিন পরে পিতা স্থির
করিলেন যে, আমাদের বংশের পূর্ব-পুরুষগণ সকলেই সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়া বিদ্যাদান করিয়াছেন,কেবল
আমাকে দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত বাল্যকাল হইতে সংসার প্রতিপালন-জন্য আশু অর্থকরী ইংরাজী
বিদ্যা শিক্ষা করিতে হইয়াছে। ঈশ্বর সংস্কৃত অধ্যয়ন করিলে,দেশে টোল করিয়া দিব”ঠাকুরদাস
এর এই ইংরেজি শিক্ষা প্রত্যাখানের সিদ্ধান্তই বিদ্যাসাগরকে পরবর্তীকালে সংস্কৃত পন্ডিত গড়ে
তোলে। আর এই সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করেই তিনি হয়ে উঠলেন উনিশ শতকের এক স্তম্ভ। পরবর্তী
কালে তিনি ফোর্টউইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনাকালে নিজ প্রচেষ্টায় ইংরেজি ও হিন্দি
শিখেছিলেন।
বিদ্যাসাগর
চরিত্রটি নির্মাণের পিছনে একটি অন্যতম অবদান ছিল তৎকালীন বাঙালির যৌথ পরিবার ও
আত্মীয়তার সম্পর্ক। বিদ্যাসাগর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পারিবারিক বন্ধনে
আবদ্ধ ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্য,শিক্ষা থেকেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন্ম তাঁর জীবনের মূল
মন্ত্র। সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন,পরিবার হল ‘সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী’(cultural mediator )। বিদ্যাসাগর এর জীবনে পরিবারের ভূমিকা ছিল
অপরিসীম। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ বিদ্যাসাগর চরিত্র নির্মাণে এই তাঁর পিতামহ,পিতা ও মাতার অবদানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই তিনি
জীবনের পাঠ নিয়ে ছিলেন। এই যৌথপরিবারগুলির কথা বলতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন
যে, এগুলি আসলে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে নির্মিত।পুরুষেই এই পরিবারগুলির
নির্ধারক।তাই এই পরিবারগুলির মধ্যেই দেখা যায় একধরনের লিঙ্গ অন্ধ( gender blind) বা লিঙ্গ দৃষ্টিহীনতা ( gender myopia) । নারীবাদী বিশ্লেষণে তাই সনাতন ভারতীয় পরিবারের সংরক্ষণবাদী দিকটিকে তীব্র সমালোচনা করা হয়। একথার সত্যতাকে
অস্বীকারও করা যায় না। বিদ্যাসাগর এরকম পরিবার থেকেই নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও
ভক্তি শিখেছিলেন। শুধু পরিবার নয় বিভিন্ন জ্ঞাতি,আত্মীয়,কুটুম্ব ইত্যাদি ইংরেজিতে
যাকে বলা কিন সেই আত্মীয়তাও বিদ্যাসাগর চরিত্রটিকে নির্মান করেছিল। বিদায়াসগরের
যখন আটবছর বয়স তখন তিনি কলকাতায় পড়াশোনার জন্য আসেন তখন জগদ্দুর্লভ বাবুর বাড়িতে
তাঁর বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিদ্যাসাগরেকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন । তাই
শম্ভুচন্দ্র বলেনঃ “ প্রাতঃকাল হইলে অষ্টমবর্ষীয় বালক অগ্রজ মহাশয়,প্রায় সমস্ত দিন
ঐ দয়াময়ী স্ত্রীলোকদ্বয়ের দয়ার উপর নির্ভর করিয়া,বিদেশে অবস্থিতি করিতেন। তাঁহারা
স্নেহপূর্বক খাবার দিতেন ও কথাবার্তায় ভুলাইয়া রাখিতেন। দাদা যখন জননী প্রভৃতির
জন্য ভাবনা করিতেন,তখন ঐ স্ত্রীলোকদ্বয় ভুলাইয়া ও কত প্রকার গল্প করিয়া সান্ত্বনা
করিতেন এবং দেশের জন্য বা জননীর জন্য ভাবিতে দিতেন না।উক্ত রাইমণি দাসী ও জগদ্দুর্লভ সিংহের পত্নীর
দয়াগুণেই শৈশবকালে অগ্রজ মহাশয় বিস্তর উপকার পাইয়াছিলেন।তাঁহারা এরূপ দয়াদাক্ষিণ্য
প্রকাশ না করিলে,দাদা কলিকাতায় অবস্থিতি করিতে পারিতেন না। অদ্যাপি ঐ দয়াময়ীর নাম
স্মরণ হইলে,দাদার চক্ষে জল আসিত।” বিদ্যাসাগরের জীবনে এই
পরিবারের বা জ্ঞাতিদের বিরাট অবদান ছিল। তাই খুব কম বয়সে কলকাতায় এসে এখানে চাকুরী
পেলেও ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত তাঁর স্থায়ী ঠিকানা ছিল বীরসিংহ গ্রামেই। যদিও পারিবারিক
নানা কলহে তাদের যৌথ পরিবার তিনি ভেঙে দেন। তবে প্রত্যেকের আর্থিক দায়িত্ব তিনি
নিজে নিয়েছিলেন। তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে থেকে বাড়ি বানানোর কথা ভাবেননি।অনেক পরে
১৮৭৪ সালে তিনি তাঁর পিতার কাছে অনুমতি নেন কলকাতায় একটি বাড়ি বানানোর জন্য কারণ
তাঁর বইগুলো রাখবে বলে। তাঁর স্ত্রীও এর
আগে কোনোদিন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেননি। যে মানুষটি তখন কলকাতার অন্যতম ধনী
মধ্যবিত্ত তিনিও সংকোচ বোধ করেছিলেন একটা বাড়ি বানাতে গিয়ে। ১৮৬৯ সালে তাঁর
গ্রামের বাড়িতে আগুন লাগলে প্রতিবেশীরা তাকে অনুরোধ করেছিল ইটের পাকা বাড়ি বানাতে
তখন বিদ্যাসাগর তাদের জবাব দিয়েছিলেনঃ “
গরীব বামুনের ছেলের পাকাবাড়ি দেখলে লোকে হাসবে”। এইভাবে নিজের আচার আচরণে,ব্যবহারে,পোশাক
পরিচ্ছেদে সর্বদাই নিজেকে গরীব বাবার সন্তান হিসেবে আজীবন পালন করেছিলেন। উনিশ
শতকের এক আগ্রাসী উপনিবেশিকতার মধ্যেও নিজের শিকড় ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার যে প্রয়াস
লক্ষিত হয়েছিল, তা বিদ্যাসাগর চরিত্রটির মধ্যে দেখা যায়। তাছাড়া সেই সময়ে যৌথ
পারিবারের যে ভিত ছিল,তারও এক ফসল বিদ্যাসাগর চরিত্রটি।
বিদ্যাসাগর
বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই গদ্যলেখার সূত্রপাত মূলত
পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে। উনিশ শতকে পাঠশালার পরিবর্তে স্কুলের দরজায় যাতায়াত
বাড়তে থাকে। পুথি নয়,টেক্সট বুকের কদর বাড়তে থাকে।ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি,শ্রীরাম
পুরের মিশনারীরা স্কুল খুলতে থাকে।মিশনারীদের স্কুলগুলিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব বাড়তে
থাকে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার ব্যাপ্তি দ্রুত হারে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
ছাত্র-ছাত্রীদের হারেও বাড়তে থাকে।এই সময়ে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন হয় বিশেষভাবে।
তবে উনিশ শতকে পাঠ্যপুস্তকের প্রথম প্রয়োজন হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। ইংরেজ
সিবিলিয়ানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করার জন্য বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের
প্রয়োজন হয়েছিল। সেই পাঠ্যপুস্তকের
বাজারে অনেক বাঙালি এসেছিলেন পাঠ্যপুস্তক
প্রকাশনায়।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এর নাম,যিনি ১৮১৮ সালে যে
ছাপাখান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার নাম ছিল
‘বাঙ্গালা গেজেটি প্রেস’বা ‘আপিস’। লেখক রাজকৃষ্ণ রায় “বীণাযন্ত্র” নামে
একছাপাখানার মালিক ব্যবসায়ী ছিলেন। বিদ্যাসাগর মশায়ও “সংস্কৃত যন্ত্র” নামে ছাপাখানার
মালিক ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে।তাঁর প্রথম অনূদিত গ্রন্থ “বেতালপঞ্চবিংশতি”
বইটির বিজ্ঞাপনে তিনি বলেনঃ “কালেজ অফ ফোর্ট উইলিয়াম নামক বিদ্যালয়ে,তত্রত্য
ছাত্রগণের পাঠার্থে বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল,তাহার
রচনা অতি কদর্য্য। ...... তৎপরিবর্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক
বিবেচনা করিয়া,উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্রীযুত মেজর জি.টি.মার্শাল মহোদয়
কোনোও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক
প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া এই গল্প লিখিয়াছিলাম।” একইভাবে বর্ণপরিচয়, কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলী,
জীবনচরিত,বোধোদয়,বাঙ্গালার ইতিহাস,শব্দমঞ্জরী, শব্দসংগ্রহ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি
লেখেন। তাই সেই অর্থে বিদ্যাসাগর প্রথম শ্রেণির সাহিত্যিক ছিলেন না। মূলত
সমাজসংস্কার ও পাঠ্যপুস্তকের জন্য তিনি লেখনী ধরেছিলেন। এই পাঠ্যপুস্তক লেখা থেকে
তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন ‘লেখক ব্যবসায়ী’। তাই বিনয় ঘোষ বলেনঃ “বিদ্যাসাগরের মূলধন ছিল বিদ্যা।বিদ্যাই
তাঁর স্বোপার্জিত মূলধন এবং তিনি ছিলেন বিদ্যার ব্যাপারী।সুতরাং বিদ্যার মূলধন
নিয়োগ করে তিনি বিদ্যাবণিক হওয়াই বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। তিনি মুদ্রক,প্রকাশক ও
গ্রন্থকার হলেন।” উনিশ
শতকের সাহেবদের সংস্পর্শে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে যে বাণিজ্যস্পৃহা দেখাগিয়েছিল
বিদ্যাসাগরের মধ্যে সেই বাণিজ্যস্পৃহাকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি ‘সংস্কৃতযন্ত্র’
নামক ছাপাখানা খোলার পর ১৮৪৭ সালে রসময় দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে তিনি চাকুরী
থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু ১৮৫০ সালে তিনি পুনরায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে যোগদান
করেন এবং ১৮৫৫ সালে তিনি ‘স্পেসিয়াল ইনস্পেকটর’ রূপে যোগদান করেন। এছাড়াও তখন যে
মডেল স্কুলগুলি নির্মিত হয়েছিল সেগুলির পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের ভার বিদ্যাসাগরের
ওপর ন্যস্ত ছিল। তখনকার যে পাঠ্যপুস্তকগুলি
সিলেবাসের মধ্যে ছিল বেশিরভাগই সংস্কৃত যন্ত্র থেকে প্রকাশিত হত। যার ফলে তাঁর
ব্যবসাও ছিল একচেটিয়া লাভজনক। উনিশ শতকে যে বিদ্যাসাগরীয় উত্থান ঘটেছিল, সেই
উত্থানের পিছনে সাহেবদের সহযোগিতা সমান ভাবে সক্রিয় ছিল।বিদ্যাসাগর চরিত্রে যেমন
তাঁর পিতা ও পরিবারের প্রতি আনুগত্য লক্ষিত হয়েছিল তেমনি কোনো কোনো সাহেবদের প্রতিও ছিল তার সমান
আনুগত্য।এই আনুগত্য যেমন তাঁর ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও দেখা যায় তেমনি
তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়েছিল। তাই বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যক্তিদের
জীবনী নিয়ে অনূদিত গ্রন্থ “জীবনচরিত” এর বিজ্ঞাপনে বলেছিলেনঃ “এতদ্দেশীয়
বিদ্যার্থীগণের পক্ষে বিশিষ্টরূপ উপকার দর্শিতে পারে এই আশয়ে আমি ঐ পুস্তকের
অনুবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম।” ভারতের মতো
দেশে সাহেবদের চারিত্র্যমাহাত্মকে তুলে ধরা এবং সেই চরিত্রকে অনুসরণ করার যে মনন
বিদ্যাসাগরের অনুবাদের মধ্যে ছিল তা আসলে সাহেবদের ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী
ডিসকোর্সে একধরনের আনুগত্য। সাহেবরা সুকৌশলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নির্মাণ করতে
চেয়েছিল। ১৮৩৫ সালে মেকলের ঘোষণা তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এই সাংস্কৃতিক
আনুগত্যের ফলেই বিদ্যাসাগরীয় মিথ নির্মিত হয়েছিল। তিনি গ্রন্থ-ব্যবসা থেকে যে
উপার্জন করেছিলেন তা দিয়ে তিনি বিধবা বিবাহ,নারী শিক্ষা,স্কুল প্রতিস্থাপন ইত্যাদি
নানারকম সমাজসংস্কারে ব্যয় করেছিলেন।এইভাবে বিদ্যাসাগর চরিত্রটি হয়ে উঠেছে উনিশ
শতকীয় চরিত্র।যে চরিত্রের মধ্যে নানা স্তর পরিলক্ষিত হয় উনিশ শতকের আর পাঁচটা
চরিত্রের মতো। এই চরিত্রটিকে ঘিরে যে মিথ নির্মিত হয়েছে,সেই মিথকে নিয়ে ভাঙা ও
গড়ার নানা খেলা চলতে থাকে প্রায় শতাধিক কাল।
গ্রন্থঋণঃ
বিনয়
ঘোষ,বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা,প্রকাশ ভবন, কলকাতা
অমিয় কুমার
সামন্ত, বিদ্যাসাগর,প্রগেসিভ পাবলিশার্স,কলকাতা
স্বপন বসু,
বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস,পুস্তক বিপণি,কলকাতা
শম্ভুচন্দ্র
বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, চিরায়ত প্রকাশন,কলকাতা
অলোক রায়, উনিশ শতক,প্রমা
প্রকাশনী, কলকাতা *ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
No comments:
Post a Comment