যদি ভাবো কিনছো আমায় ভূল ভেবেছো...
১৯৯৮ সাল সেটা। আমি তখন শহর বর্ধমানের
একটি থিয়েটারের দলের অভিনেতা। সেই দলের সম্ভবত দুটি কি তিনটি প্রযোজনায় অভিনয় করছি।
সম্ভাবনাময় অভিনেতা হিসাবে দর্শক ও বিদগ্ধ মহলে বেশ চর্চায় আমার নাম। তখন থিয়েটারের
শো বলতে প্রতিযোগিতার মঞ্চই বেশী। অভিনেতার সঙ সেজে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ
অভিনেতার কিছু পুরস্কার আমার দখলে তখন। সাধ হলো থিয়েটারের হোল টাইমার হবো। কিন্তু সাধ
আর বাস্তব যে এক বস্তু নয় তা বুঝতে সময় বেশী লাগলো না। অগত্যা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত
ছাত্র পড়ানো। সেটাই ছিলো আমার থিয়েটার রাঁধার জ্বালানি যার মৌতাতে বিকেলের পর থেকে
থিয়েটারের মহড়ায় আমার প্রাণভোমরা সোনার কাঠির ছোঁয়া পেত। আসলে সেই বিকেল গুলো কখন যে
রাতে শেষ হতো তা বুঝতে বুঝতেই আর একটা সকাল বাস্তবের খামে ভরা চিরকুট পাঠাতো আমায়।
চিরকুটেরা আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিতো উত্তর। উত্তর দেখে আমি নিজেই হাসতাম....হো হো করে।
সেই হাসির কোটরে লুকিয়ে থাকতো রঙচঙে এক দৈত্য। সে কিন্ত বদ ছিলো না। দৈত্য আমার পাশাপাশি
চলতো ছায়ার মতো। শীতল গভীর রাতে আমায় উষ্ণতা দিতো। তুখোর রোদে মিঠে বাতাস দিতো সে আমায়।
আমার কান্না জড়ানো চোখে নরম আঙুলের আশ্রয় দিতো.....আমায় জড়িয়ে ধরতো পেঁজা তুলোর স্পর্শ
দিয়ে....
কানে কানে বলতো ,"মঞ্চের উপরের
তোমার ঘর, তোমার বাড়ি, তোমার আরশীনগর", তোমার লাশ... তোমার চিতা....তোমার কফন
....."
আমার সকাল গুলো তখন রোদ ঝলমলে...
দুপুরেরা মাতাল....কিশোরীর মতো বিকেল গুলো আমার হাত ধরে নিয়ে চলে রাত জাগা কতো ভোরের
থিয়েটারে....
বেপরোয়া আমি তখন মহড়ায় পেতেছি সংসার....রাতের
পর পাড় হয় ঘোরমাখা থিয়েটারের মঞ্চমায়ায়।
বছর গুলো সরে যায় ট্রাম লাইনের
মতো। যেমন করে পুরনো রাজবাড়ির দেওয়ালের জল রঙের ছবি
গুলো ফিকে হয়ে আসে....সে পথ ধরে
এগিয়ে চলে আমার বোহেমিয়ান জীবনে বেঁচে থাকার থিয়েটার......
এদিকে শহর বেড়ে ওঠে ময়াল সাপের
মতো এঁকে বেঁকে....
গিলে ফেলতে চায় যা কিছু পুরনো সব।
ছাঁচে ঢেলে নতুন কলেবর আনবে নতুন বোতলে.....আমার মতো অনেক আমি থিয়েটার থেকে চুইয়ে পরা
মহুয়ার নেশায় মাতাল .......
শহর সাজে....আমার আমিরাও সাজে...গতিময়
দুরন্ত হরিণের মতো একটা রাজনৈতিক সময় এসে চোখে রাখে চোখ.....সমাজ বদলের ডাক.... সাথে
করে থিয়েটার.....
সন্ধ্যের পর নিয়ন আলোর বিজ্ঞাপন
রাত আটকায়। আকাশের তারায় তারায় তবু জাগে স্বপ্ন। বদলাবে দিন। আসবে সুদিন....
তবু ঐ যে " কেনা যায় কন্ঠ
আমার দফা দফা"........
তখন তো বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রছাত্রিদের
মধ্যেও থিয়েটারের মায়াবী আলোর ছটা পড়ে গেছে। তাদের পড়াশুনা.........গোলাপবাগের লাল
মাটি....প্রেম... ক্যাম্পাসের মেহগনি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রেমিক এঁকে
দেয় তার প্রেমিকার ঠোঁটে থিয়েটারের মহড়ায় না দিতে পারা গভীর চুম্বন। থেকে যায় সেই চুম্বনের
রেশ। সেই রেশ ধরেই পরবর্তী মহড়া চলে.....সে এক অদ্ভুত অসামান্য থিয়েটারের দিন যাপন.....কখন
আমার থিয়েটারের পরশ পাথর হয়ে গেল তার টের পেলাম যখন শহরটার সদর দরজাটা একটু একটু দখল
নিতে থাকলো সমাজ বদলের কারিগরদের মেদ জমা মগজ......আসলে তখনই সরতে থাকলো পথ...পুড়তে
থাকলো আশা... ভাঙতে থাকলো হৃদয়....স্বপ্নেরা ঘুমোলো....
শহর হলো রূপসী.....মেদজমা মগজেরা
নিতে থাকলো ত্বকের যত্ন......এও তো এক নব্য থিয়েটার ই.......
কখনো মঞ্চে আমরা....রাস্তায়ও মাঝে
মধ্যে। রাস্তার মানুষগুলোর মুখ গুলো সব এক রঙের। নেই কোন বৈপরীত্য,বৈচিত্র.......
শহর বাড়তেই থাকলো.......
আমরা হাঁটতে থাকলাম শহরের ফুটপাতের
এক কোণ ঘেঁষে....বিকল্প কৃষ্টির দেখার আশায়। আমাদের থিয়েটারে নায়কের কাঁধে গামছা। বিকল্প
সব কিছু....বিকল্প হাসি... কান্না বিকল্প... বিকল্প রাগ......বিকল্প আবেগ মোড়া থিয়েটারে
আমাদের নায়ক শোনায় কয়েকজন আমি'র গল্প। এদিকে মাখন রঙের ত্বকের মগজেরা পথ আগলে বসে পড়ে
জগদ্দল পাথরের মতো......প্রাণহীন সেই পাথর নড়েও না চড়েও না। হাজার হাজার থিয়েটার পারেনা
টলাতে তাদের......আসলে শক্তি কোথায়? অশক্ত শরীর নিয়ে টলমল পায়ে হেঁটে চলে আমাদের থিয়েটার......কখনো
ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পথই খুঁজে পায় না।
"রুজি রোজগারের জন্য করছি রফা"
শহরের বুক চিরে এখন মাল্টিপ্লেক্স....
মেট্রো.... আইনক্স.....মিও আমোরের ফ্রিজে রাখা খাবার... প্যান্টালুনসের পোষাক....তানিস্কের
হীরের নেকলেস....
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে উর্দি পরা
বেসরকারি দেহরক্ষী...ঐ যে ছায়া সুন্দরী গোলাপবাগ এর সামনের
লাল রাস্তা....কাশ্মীরি
তরুণীর বোরখা ঢাকা শরীর ঢেকে গেল যেন কালো পিচে...........আর আঁকা বাঁকা উচ্চতায় আকাশ
ছুঁতে চায় শহরের উড়ালপুল...
কত কত থিয়েটার আসে যায়.....
" আমাকে না আমার আপস খাচ্ছো তুমি"
অজস্র থিয়েটার রঙ মাখে...সাজে সঙে....
তবু বলতে পারেনা সংলাপ.... বলতে পারেনা তলোয়ারের চোখে চোখ রেখে...... দাঁড়াও সম্মুখে।
কোম্পানি নারায়ণ থিয়েটারের কন্ঠে
পড়িয়ে দিয়েছে যে কন্ঠহার.....তাই তো কন্ঠ বড় সুন্দর সুর ছড়ায়...
যে সুরে গলা চিরে যায়.... নেই সেই
সুর..... আমার শহরের মতোই তো..... সজ্জায় পোষাকে.... নতুন যুবকের চেহারায়....না বলা
কথার থিয়েটার....কত কথা বলে চলে অভিনেতারা.....শুনতে পায়না কোন দর্শক..... এ শহরও বলতে
চায় অনেক কথা.... পারে কই?
পারে না অট্টহাসি.....পারেনা কাঁদতে....সাথের
অভিনেতার হাতে রাখতে পারেনা হাত.....
হাতরায় ...খোঁজে....চেষ্টা করে
চিৎকার করার......
এ শহরের হাত ধরে থিয়েটার আজ চুপকথা
কয়....
কে যেন পাশটিতে বসে কানের কাছে
বলে... .
No comments:
Post a Comment