বিদ্যাসাগরঃ পার্থজিৎ চন্দ




                                     
‘তিনি’ ও জনৈকের কথোপকথন


-   আপনি যখন একটি লজঝড়ে অটোয় চেপে বড়োবাজার থেকে উল্টোডাঙা এসে, আরেকটি অটো পালটে দমদম এয়ারপোর্টের সামনে এই হোটেলের সামনে এসে নামলেন, তখন আমার উড়ানখাটোলা এয়ারপোর্টের মাটি স্পর্শ করছিল আপনার সঙ্গে আমার মোলাকাত হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না কিন্তু একটি বিশেষ কারণে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম আপনার বিষয়ে আমার বেশ কিছু কথা জানবার আছে যদিও আমি আপনার থেকেও বড়ো এই দেখুন আমার ছায়া কত বড়োআপনার সীমানা ছাড়িয়ে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে হোটেলের লনে

-   আপনার উড়ানখাটোলা আমার মাথার উপরেই চক্কর খাচ্ছিল আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আপনার উড়ানখাটোলার শব্দ এবং বুঝতে পারছিলাম, আজকাল আমাদের দেশের অযোগ্য মানুষগুলিই সব থেকে উঁচুতে ওড়াউড়ি করে

-   আপনি আমাকে অযোগ্য বললেন? জানেন, আমি আপনার মাথার খুলি এক নিঃমেষে উড়িয়ে দিতে পারি ইনফ্যাক্ট, সত্তরের দশকে আপনার মূর্তি ভাঙা শুরু হয়েছিল যদিও সে সব করেছিল আগুনখোর বিপ্লবীরা আমি ও আমার ফলোয়াররা এইসব আগুনখোর বিপ্লবীদের সমর্থন করি না দুচক্ষে দেখতে পারি না তাদের শুধু এই একটা-দুটো জায়গায় এই সব হঠকারি বিপ্লবীদের সঙ্গে আমাদের অদ্ভুত মিল তারাও আপনার মূর্তি ভেঙেছে আমরাও আপনার মূর্তি ভেঙেছি এই ভাঙচুরের পিছনে যুক্তিগুলি শুধু বদলে বদলে গেছে

-   রাজনীতি জিনিসটা আমার বেজায় গোলমেলে লাগে, বুঝলেন। চিরকাল একগুঁয়ে বলে আমার একটা বদনাম ছিল। আমি বেঁচে থাকতেই কংগ্রেস তৈরি হয়েছিল। কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসেছিল কলকাতায়। রাজেন মিত্তির খুব জোরাজুরি করেছিল যোগ দেবার জন্য। কিন্তু আমি তো বক্তৃতায় বিশ্বাস করি না। দেশের লাখ লাখ লোক অনাহারে মরবে আর আমি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াব, ওটি আমার দ্বারা হবার ছিল না। আমি জানতে চেয়েছিলাম কংগ্রেসের নেতারা অস্ত্র ধরতে রাজি কিনা... কোনও উত্তর পাইনি। যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল সত্তর দশক তার শুরু তো আমার হাত দিয়ে হতে পারত অনেকদিন আগেই। ইতিহাসের কী অদ্ভুত খেলা; ওরাই আমার মূর্তি ভেঙেছে। যদিও ওই মূর্তি-টুর্তি’তে আমার কিছুই যায় আসে না...


-   এ কারণেই আপনাকে বেশ বিপজ্জনক বলে মনে হয়। আপনার তেমন কোনও সংঘ নেই, গুরুবাদী ঘরাণা নেই। তবু আপনি টিঁকে রয়েছেন বহাল-তবিয়তে। যাই হোক, আজই একটি মূর্তি উদ্বোধন করে এলাম।

-   জানি। এবং সেটা করতে গিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে বাস্তুহারা হতে হয়েছে। লাখ লাখ গাছ কেটে সাফ করে দিয়েছেন আপ্নারা। কর্মাটাঁড়ে থাকার সময়ে দেখেছিলাম, আমার দেশের ‘আদি বাসিন্দারা’ কতটা গরীব আর অসহায়...


-   ওদের সব সহ্য করবার অভ্যাস আছে। ঠিক টিঁকে যাবে, দেখবেন। আর ভালো কাজ কিছু করতে গেলে এসব একটু-আধটু করতেই হয়...

-   হ্যাঁ, ঠিক যেমন আমাদের সময়ে সমাজপতিরা ভাবত বিধবারা ঠিক টিঁকে যাবে। গু-মুতের মধ্যে একটা জীবন কাটিয়ে দেবে...


-   আপনার বিরুদ্ধে আমাদের গোপন মিটিঙে একটা প্রস্তাব পাস হয়েছে। অনেক ভেবেচিন্তে আমরা দেখেছি, আর্বান নকশালরাও আপনার কাছে শিশু। অবুঝমাড়ের জঙ্গলে যারা পুলিশের জিপ উড়িয়ে দেয় তারা তো শুধু জিপ’ই উড়িয়ে দেয়।আপনি অনেক বেশী কিছু উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আপনি বাংলায় হিন্দুধর্মের বেশ ক্ষতিই করেছেন... আপনি যদি না-জন্মাতেন...

-   হ্যাঁ, তা হলে আপনাদের খাটাখাটুনি বেশ কমে যেত। মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে রাখতে পারলে তো কিস্তিমাত...


-   ঠিক ধরেছেন। তবে আপনার বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অ্যলিগেশন, আপনি নাকি ধর্মকে বেশ বাঁকা চোখেই দেখতেন... এমনকি গ্রামের বাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টাকা বাঁচিয়ে গরিবদের সাহায্য করবেন বলে। সে সময়ে আমাদের রবরবা থাকলে এতদিন আপনাকে টিঁকে থাকতে দিতাম না... ধর্ম থাকলে তবেই মানুষ থাকবে। নিজের ধর্ম নিয়ে নো-চুদুরবুদুর। আমরা এটা বরদাস্ত করি না। আর আপনি ঠিক সেটাই করেছেন...

-   সারা জীবন তো পড়াশোনা করে কাটিয়েছি... বুঝেছি ধর্ম নিয়ে আমরা আমাদের ব্যাখ্যা সুবিধা মতো নির্মান করে নিই।


-   তা বলে হীরা বুলবুলের ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করবার পক্ষে সওয়াল করবেন?
-   হ্যাঁ করেছিলাম। হীরা বাইজি। এমনকি হীরার সারা জীবনটাই অবৈধ হতে পারে, কিন্তু তার গর্ভে জন্মানো শিশু কিছুতেই অবৈধ হতে পারে না...
-   সে সময়ের পক্ষে বেশ বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলেন। এমনকি এখন হলেও আমাদের ধর্ম সুরক্ষা বাহিনীর হাতে মার খেতেন...
-   নিশ্চিত মার খেতাম। কারণ আমি অষ্টমী আর প্রতিপদে সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকার নিয়ম পরিবর্তন করেছিলাম। আমার সময় থেকেই কলেজ শুধু রবিবার ছুটি থাকতে শুরু করে।


-   আপনারাই হিন্দু সংস্কৃতিকে নষ্ট করেছেন। বিদেশী কালচারকে দু’হাতে আহ্বান করেছেন। আপনার জন্যই এই বঙ্গে আমাদের অবস্থা বেশ নড়বড়ে। আপনার বিরুদ্ধে অনেক খুঁজেও তেমন যুতসই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের আইটি সেল থেকে বিদগ্ধ লোকজন, সবাই সক্রিয়। কিছু পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে... হারামিতে দেশ ছেয়ে গেছে। লোকে আমাদের লোকজনের মুচলেকা থেকে শুরু করে নানান কাণ্ডকারখানার হদিশ ঠিক পেয়ে যায়। শুধু আপনারই পাওয়া যায় না। আর যাও বা পাওয়া যায়, সব যেন কেমন ন্যাতানো আর ম্যাদামারা। ঘুরেফিরে আপনার শেষ বয়সের নিঃসঙ্গতা আর বিধবাবিবাহের সমর্থক হয়েও পাশের গ্রামের এক বাল্য-বিধবার বিবাহে সমর্থন না-জানানো... ব্যস, ওই পর্যন্তই। এই মাল নিয়ে খুব বেশী দূর যাওয়া যাবে না...
-   জানি আপনাদের পড়াশোনার অভ্যাস বেশী নেই। তবু বলি, আমার সমালোচনা করতে হলে শ্রীশচন্দ্র মজুমদার আর বিনয় ঘোষের বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন।
-   আপনাকে নিয়ে হাঙ্গামার শেষ নেই। আমাদের সেল পড়েছে বই দুটি। আপনি বিপ্লবী নন; বিধবা বিবাহের সমর্থনে শেষমেশ আপনাকে ধর্মগ্রন্থের সাহায্য নিতে হয়... এ সব লেখা আছে। কিন্তু সে দিয়ে চিঁড়ে ভিজবে না আমরা জানি...
-   আসলে কী জানেন, আমার সমালোচনা করা সহজ। আমাকে অনুসরণ করা কঠিন। শ্রীশ আর বিনয়ের বই দুটি আমারও পড়া। কিন্তু বিরুদ্ধ মতকে অশ্রদ্ধা করতে শিখিনি কোনও দিন। শ্রীশ আর বিনয়ের উপর আমার কোনও ক্রোধ নেই।
-   আমার বিরুদ্ধে কেউ এর এক অংশ লিখলেও তাকে আমি ছেড়ে কথা বলতাম না। সে আলাদা কথা; আপনাকে মুছে দেবার সব উপাদান রেডি করাই ছিল। আগুন জ্বালিয়ে আপনার সব বই পুড়িয়ে দিতাম আমরা। সব মূর্তি ভেঙে দিতাম। শুধু একটা কারণে পারা যাচ্ছে না...
-   কী কারণ? কী কারণ?
-   আমাদের গো-মাতা সেল অনেক খুঁজেপেতে দেখতে পেয়েছে আপনি নাকি বাছুরের দুঃখে গরুর দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন! ওই একটা জায়গায় গোল বেঁধে আছে।
-   আমার মায়ের নাম ভগবতী, কিন্তু আমি গোমাতার সন্তান নই। সত্যি সত্যি বাছুরের দুঃখেই আমি গরুর দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।
-   তাহলে কি আপনি আমাদের লোক? মানে অতদিন আগেও...
-   শুনলে দুঃখ পেতে পারেন... আমি গায়ত্রী মন্ত্র ভুলে দিয়েছিলাম। ওই অংবংচং-এ আমার কোনও বিশ্বাস ছিল না আর। আমি শুধু মায়ের ছবির সামনে বসে কাঁদতাম। উনি ছাড়া আমার আর কোনও দেবতা ছিল না।

-  আপনার আর আমার অদ্ভুত কিছু মিল আছে শোনা যায় আপনার জন্মের আগে ভগবতীদেবীর নাকি উন্মাদরোগ ছিল। আপনার জন্মের পর সেরে যায়...

-   আর আপনার জন্মের পর আপনার মায়ের উন্মাদরোগ শুরু হয়...
-   আমার গেস্টাপো বাহিনী দিয়ে এক নিমেষে আপনাকে গুম করে দেওয়া যায়। শুধু শুনে রাখুন রামজয় তর্কভূষণের নাতি বলে আপনি পার পেয়ে যাচ্ছেন। আপনার জিভ টেনে ছিঁড়ে নিতাম। নেহাত রামজয় প্রবাস থেকে ফিরে আপনার জিভে মন্ত্র লিখে দিয়েছিলেন। মন্ত্রে-টন্ত্রে আমাদের অগাধ আস্থা। তাই...
-    
-   আমাকে আপনারা মারতে পারবেন না। কারণ মৃত্যুর পরই আমার প্রকৃত জীবন শুরু হয়েছে। যাক, এবার ওঠা যাক। আপনার-আমার মধ্যে শুধু একটাই মিল। আমিও আবিস্কার করলাম। আমার জিভে আমার পূর্বপুরুষ সরস্বতী-মন্ত্র লিখে দিয়েছিলেন। আর আপনার জিভে লেখা রয়েছে দুষ্ট-সরস্বতীর মন্ত্র…

-   এই আপনার মাথা লক্ষ্য করে আমাদের গেস্টাপো বাহিনী গুলি চালাল। আপনার খুলি উড়িয়ে দিলাম আমরা…


-   তবু দেখুন, কী আশ্চর্য... যে শিরদাঁড়া বজ্র দিয়ে তৈরি তাকে নোয়াতে পারছেন না কিছুতেই। আপনারা কত অসহায়...

*  *ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।





No comments:

Post a Comment

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com