গোটা দেশ উত্তাল, চারিদিকে
হইচই। কিন্তু এত হট্টগোলের আছেটা কী? ব্যাপারখানা আদৌ কি এত জটিল নাকি? দেশের যে বাসিন্দারা
'নাগরিক' হিসেবে নিজ অস্তিত্বের বৈধতা প্রমান করতে পারবেন তাদের নাম উঠবে 'জাতীয় নাগরিক
পঞ্জি'তে। এই তো সহজ কথা! তাছাড়া কেন্দ্র সরকার এবং শাসক দলের পক্ষ থেকে তো বারংবারই
বলা হচ্ছে, আতঙ্কের কারণ নেই কোনও। কোনও ভারতীয় নাগরিক সন্তোষজনক ডকুমেন্ট জমা দিলে
তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রশ্ন নেই।
দু’ সেকেণ্ডের জন্য আমরা নাহয় বিনা তর্কে
মেনে নিলাম কথাটা, আমরা নাহয় সরকার ও শাসকদলের দেওয়া আশ্বাসে আশ্বস্ত হলাম! ধরে নিচ্ছি,
কেউ আপনায় তাড়িয়ে দেবে না! আপনি থাকতে পারবেন নিজের দেশেই। ব্যাস, মিটে গেল!
মিটল কি সত্যিই? নিজের দেশেই থাকার জন্য
অ্যাপ্লিকেশন করতে যাবেন কোন্ দু:খে? নানাবিধ দলিল দস্তাবেজ বৈধ প্রমাণপত্র হাতে লাইন
লাগাতে হবে কেন সরকারি দপ্তরে? নিজের দেশেই থাকার জন্য রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করতে হবে?
ডকুমেন্ট যাচাই করে রাষ্ট্র যদি মঞ্জুর করে আবেদন, বাধিত হবেন আপনি?
আজ্ঞে, আপনার নাগরিকত্ব থাকবে কি থাকবে না সেটা
অনেক পরের প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন হল, আপনি বাধিত হবেন কিনা! রাষ্ট্রের সাথে এমন অপমানজনক
কোনও শর্তে বাঁধা পড়তে রাজি আছি কিনা আমি?
এই যে প্রশ্নটা, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের
সম্পর্ক কী হবে, এইটেই ছিল আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। NRC কার্যত সেই
প্রশ্নটাকে ধরেই টান মেরেছে। এবং টান যেহেতু লেগেছে এক্কেবারে শেকড়ে, স্বভাবতই নড়ে
উঠেছে গোটা গাছটা। তার প্রতিটি ডালপালা। ভিত নড়ে গেছে আমাদের অস্তিত্বের।
‘আমাদের’ মানে কোনও বিশেষ ধর্মের লোকেদের নয়। ‘আমাদের’
মানে এ দেশের প্রতিটি মানুষের। সংবিধানের প্রস্তাবনায় যাদের “উই দ্য পিপল অব ইণ্ডিয়া”
বলা হয়েছে, যাদের নামে গৃহীত হয়েছে এদেশের সংবিধান, ভিত নড়ে গেছে তাদেরই অস্তিত্বের।
সংসদে “নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৯” পেশের সময়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছেন, এই আইনে ‘ভারতীয় মুসলমান’-দের ভয়ের
কোনও কারণই নেই। অথচ ইতিপূর্বেই আমাদের সকলের ‘ভারতীয়’ পরিচিতিটির সামনেই তো প্রশ্নচিহ্ন
ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বাওয়ালের সূত্রপাত এখান থেকেই।
যেহেতু
আমি ‘ভারতীয়’ কিনা এটাই এখনও ক্লিয়ার হয়নি, ফলে এখন আমি ‘ভারতীয় হিন্দু’ বা ‘ভারতীয়
মুসলমান' কিংবা ‘ভারতীয় বৌদ্ধ’/’ভারতীয় জৈন’/’ভারতীয় খ্রিস্টান’/’ভারতীয় অধার্মিক’
কিছুই নই। তাহলে “ভারতীয় মুসলমানদের ভয়ের কোনও কারণ নেই” কথাটারও কোনও মানেই নেই। কেননা
এই মুহূর্তে তো ‘ভারতীয় মুসলমান' বলেই কেউ নেই কোথাও। আছে কেবল 'মুসলমান'। কেবল ‘হিন্দু’,
‘বৌদ্ধ’, ‘শিখ’, ‘জৈন’, ‘পারসিক’, ‘খ্রিস্টান’। কিংবা অন্য কোনও তথাকথিত ‘অপ্রধান’
ধর্মীয় পরিচিতির মানুষ। এঁদের সকলকে দাঁড় করানো হয়েছে একটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে। এখন
‘ভারতের নাগরিক’ হওয়ার জন্য এদের সকলকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে। কমন এনট্রান্স টেস্ট!
এদিকে
পরীক্ষা শুরুর আগে একটা আইন বানিয়ে বলা হল, এদের মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ
থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, খ্রিস্টানদের পরীক্ষায় ফেইল করানো হবে না।
তাহলে ফেইল করার সম্ভাবনা থাকল স্রেফ কার? এবার বলুন, ভয় পাওয়ার কারণ আছে কি নেই? সাধারণ
বুদ্ধিতে কী বলে?
সরকার
অসাধারণ। তাই বলবে, ভয়ের কারণ নেই। আপনাকে হোয়াটস্অ্যাপে জানানো হবে, এ আইন কারো নাগরিকতা
কেড়ে নেওয়ার জন্যে নয়, দেওয়ার জন্যে। যদি তাই হয়, তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল?
নাগরিকতা
তো কেবল তাকেই দেওয়া সম্ভব, যার সেটা নেই! যে ভোট দিয়ে সরকার গড়েছে, যে অলরেডি নাগরিক
তাকে ফের নাগরিকতা দিতে হলে আগে তার নাগরিকতাটা কাড়তে হবে। যেমন কালো টাকা উদ্ধারের
খোয়াব দেখিয়ে আদতে কালো টাকা সাদাই করা হল। নাগরিকতা দেওয়ার লোভ দেখিয়েও আদতে তেমনই
নাগরিকতা কেড়ে নেওয়ার কৌশল। নাগরিক অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়ার। হুবহু নোটবন্দীর কায়দায়
ভোটবন্দি বললে কি অত্যুক্তি হবে?
শাসকদল
খুব করে বোঝাতে চাইছে, এ আইন কতটা মানবিক!
পাশের দেশের আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের বুকে আগলে নেওয়ার জন্যেই এত আয়োজন! বিপন্ন
সংখ্যালঘুকে দরাজ হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারাটা সত্যিই একটা বড়ো ব্যাপার। সরকারের এই পদক্ষেপকে
নিঃসন্দেহেই সংবেদনশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মেনে নেওয়াই যেত, যদি নিজের দেশের
সংখ্যালঘুদের বিপন্নতাতেও খানিক সভানুভূতি থাকত তাদের!
রীতিমতো
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজের দেশের সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি যথেচ্ছ ঘৃণা ও হিংসা ছড়িয়ে
পাশের দেশের আক্রান্ত সংখ্যালঘুর জন্যেও যদি কেউ চোখের জল ফেলে, কুমিরের কান্না ছাড়া
কী আর বলবে তাকে লোকে? একদিকে গোরক্ষাবাহিনি পুষব, দেশজুড়ে একের পর এক গণপিটুনির প্লট
বানিয়ে সফলভাবে থেঁতলে মেরে ফেলব আখলাখ-জুনেইদ-পেহলু খানেদের আর পাশের দেশে সংখ্যালঘুরা
কতভাবে আক্রমনের শিকার হয় তার গপ্পো শুনিয়ে সুড়সুড়ি দেব পাবলিকের সেন্টিমেন্টে! এ কেমন
দোগলামি?
ভারতের
জনসংখ্যার বিপুল অংশ তপশিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর জাতিভুক্ত মানুষ। হাজার
বছর ধরে আক্ষরিক অর্থেই ‘দলিত’। অত্যাচারিত। গত ছয় বছরে তাঁদের ওপর অত্যাচার বেড়েছে
বহুগুনে, রীতিমতো রাষ্ট্রীয় মদতেই। বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য, শোষণ। রোহিত ভেমুলার কথা
মনে আছে? হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে
গবেষককে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার
হতে হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৭ই জানুয়ারি! কড়া হাতে সামাজিক শোষণ, অত্যাচার বন্ধের জন্য
সেই ছেলেটার নামেই 'রোহিত অ্যাক্ট' বানানোর দাবি উঠেছে দেশে। দলিত, মুসলিমদের ওপরবেড়ে
চলা গণপিটুনির আবহে বেসরকারি সামরিক বাহিনির বিরুদ্ধে দেশে ফৌজদারি আইন বানানোরও দাবি
উঠছে গত বছর পাঁচেক।
দেশের
বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে আইন বানায় না যারা, পাশের দেশের বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে আইন
বানাচ্ছে সেই সরকারই! সন্দেহ হয়, এটা এ দেশেরই সরকার তো নাকি পাশের দেশের?
দেশ,
দেশের কাঁটাতার অতিক্রম করে সমস্ত আক্রান্ত, বিপন্ন মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখাক
সরকার। মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার এইটুকু মানবিক হবে না?
তাহলে
বেছে বেছে তিনটে দেশ কেন? বেছে বেছে ছ’টা ধর্মই বা কেন? আইন বানানোর সময় কেন হিন্দু,
বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, খ্রিস্টান বাদে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষের কথা, বিভিন্ন
জনজাতির মানুষের কথা ভুলে গেল সরকার বাহাদুর? মুসলমানের ঘরে জন্মেও যে মানুষ ইসলাম
ধর্ম পালন করে না, যে মানুষ যুক্তিবাদী নাস্তিক বলে আত্যাচারিত হয় বাংলাদেশে, তাকে
নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা নেই কেন? শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুদের শিকার হতে হয় না সাম্প্রদায়িক
হিংসার? হতে হয় না খ্রিস্টানদের? তাঁদের বাদ দেওয়া হল কেন? পাকিস্তানের আহমদিয়া কিংবা
শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলিমরাও সেদেশে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু, আক্রান্ত, বিপন্ন। তাঁদের
কেন বাদ দেওয়া হল, প্রশ্ন করলে চুপ থাকছে সরকার।
কেন
বেছে বেছে এই তিনটে দেশের কথাই বলা হল, এ প্রশ্নের একটা উত্তর অবশ্য আছে বিজেপির কাছে।
ওরা বলছে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কেবল আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেরই
‘সরকারি ধর্ম’ রয়েছে। অর্থাৎ এই তিনটেই “ধর্মীয় রাষ্ট্র” তাই এই দেশগুলিতে যারা সংখ্যালঘু,
তাঁদের ওপর হামলা হয়। যাচ্চলে, তাহলে কি যে দেশের সংবিধানে লিখিতভাবে কোনও ‘সরকারি
ধর্ম’-এর উল্লেখ নেই সেই দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয় না? আমাদের নিজেদের
দেশের অভিজ্ঞতাটা কী?
তাছাড়া
ওই তিনটে দেশের সংবিধানে যাই থাক, ভারতের তো কোনও ‘সরকারি ধর্ম’ নেই। এবং আইনটা আপনারা
ওই দেশগুলোর জন্য বানাচ্ছেন না, বানাচ্ছেন ভারতের জন্য। তাহলে কেন? কেন একটা ধর্মনিরপেক্ষ
রাষ্ট্রের ‘নাগরিকত্ব আইন’-এ ধর্মের প্রসঙ্গ জুড়ে দেওয়া হবে?
হিন্দুদের
বাঁচানোর জন্যে? আসামে NRC-র চূড়ান্ত যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে নাগরিকত্ব হারানো
মানুষের বেশিরভাগই হিন্দু। এ অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের সামনে আসতেই পাড়ায় পাড়ায় চায়ের
দোকানে, বাসে, ট্রেনে, হনুমান মন্দিরে, হোয়াটস্অ্যাপে বলা শুরু হল, অমিত শাহ নাগরিকত্ব
আইন পালটে “হিন্দুদের বাঁচিয়ে দেবেন”! সত্যিই
কি এই আইনের জোরে হিন্দুরা বেঁচে যাবে? বাকি আরও যে পাঁচটা ধর্মের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে,
সেই ধর্মের লোকেরা কি বেঁচে যাবে?
গোটা
আইনে একবারও এই ছটি ধর্মের মানুষকে নির্বিচারে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে
কি? শুধু বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট তিনটে দেশ থেকে আসা নির্দিষ্ট ছটা ধর্মের মানুষ ‘অবৈধ
অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত হবেন না। নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন তাঁরা এবং
এই আবেদন করার ক্ষেত্রে কিছু আইন শিথিল করা হয়েছে।
কী
করতে হবে আবেদন করার জন্য? প্রমাণ করতে হবে যে আপনি ওই তিনটের মধ্যে কোনও একটা দেশে
ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে এসেছেন। আজ্ঞে, প্রমাণ তো করতেই হবে। কীকরে প্রমাণ
করবেন? অবশ্যই প্রামান্য কাগজপত্র দিয়ে। কী সেই প্রামান্য নথি?
ধরা
যাক, আমি একজন হিন্দু এবং বাংলাদেশে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যাগুরু মুসলিমদের দ্বারা ধর্মীয়
অত্যাচারের শিকার হয়ে এই দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছি। ধরা যাক, চোখের সামনে বাবাকে খুন হয়ে
যেতে দেখেছি আমি। দেখেছি মায়ের ধর্ষণ। ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভিটে খাক হয়ে গেছে।
প্রাণ হাতে আমি পালাতে পালাতে গ্রাম নদী নালা পেরিয়ে এসেছি, কাঁটাতার পেরিয়ে এসেছি।
সাথে ছোট ভাই ছিল, গুম হয়ে গেছে! সাথে ছোট বোন ছিল, পথে পথে গুম হয়ে গেছে। আমি কাঁটাতার
ডিঙিয়ে, মানচিত্র পালটে ঢুকে পড়েছি এই মানচিত্রে। ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের আগের
কোনও একদিন। আজ আমার জন্যে আইন পাশ করালেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! আইনের বলে আমি
আর ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ নই। আমি আবেদন করতে পারব ভারতীয় নাগরিকতার। আবেদনপত্রের সাথে
জমা দিতে হবে কোন সেই ‘প্রামান্য নথি’ অত্যাচারিত হওয়ার? কাঁটাতার ডিঙোনোর আগে বাংলাদেশের
কোনও থানায় করা এফ আই আর-এর কপি? কাঁটাতার ডিঙোনোর পরে ভারত সরকারকে দেওয়া কোনও নথির
জেরক্স? কী দিয়ে প্রমাণ করব আমি আজ আমার বাপের হত্যা? মায়ের ধর্ষণের প্রমাণ দেবে কোন্
ডকুমেন্ট?
ভিটেমাটি
খুইয়ে সর্বশান্ত যে মানুষ এদেশে এসেছেন, তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয়েছে তাঁকে মাথা গোঁজার
সামান্য ঠাঁই। দরমার বেড়া, রিফিউজি কলোনি। কত রকমের পেশা, কত মেহনতে একটু একটু করে
জীবন ধারণ করতে হয়েছে। কত ঝড় ঝাপ্টায় হয়তো ভেঙেছে সংসার, তামাদি হয়েছে জীবন। ফের প্রতি
পদক্ষেপে লড়াই, হয়তোবা উঠে দাঁড়িয়েছেন আবার। কোন ইতিহাস খুঁড়ে আজ নিয়ে আসবেন রিফিউজি
স্লিপ? মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট? তারচেয়েও বড়ো কথা, সেদেশে “ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার” হওয়ার
অলীক প্রমানপত্র? কীকরে বাঁচবে সে মানুষ?
আদতে হিন্দুদের বাঁচানোর জন্যে নয়, অপর পাঁচটি ধর্মের লোকেদেরকেও বাঁচানোর
জন্যে নয়। এ আইন বানানো হয়েছে বিলকুল অন্য কারণে।
দেশের এ কল্পনা একা রবি
ঠাকুরের নয়। এই গানেরই প্রথম স্তবককে 'জাতীয় সঙ্গীত' হিসেবে গ্রহণ করে স্বাধীন ভারত
কার্যত এই কল্পনাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিই দিয়েছে। বলাই বাহুল্য যা RSS-এর না-পসন্দ!
"হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী"-র মধ্যে থেকে বেছে বেছে
'মুসলমান'কে খুপলে নেওয়ার আইনি বন্দোবস্ত হলে ছিঁড়ে দেওয়া সম্ভব 'প্রেমহার'টিকে।
যেভাবে সংশোধন করা হল এ আইন, তাতে
ভারতের “নাগরিকত্ব আইন”-এ ধর্মের নাম উল্লেখ করে দেওয়া গেল! কে নাগরিক আর কে নয় সেটা
নির্ধারণে একটা ধর্মীয় অ্যাঙ্গেল জুড়ে দেওয়া গেল! কাউকে বাঁচানো ওদের উদ্দেশ্যই নয়,
লক্ষ্য কেবল RSS-এর অ্যাজেণ্ডাকে চ্যাম্পিয়ন করানো।
নাহলে
এই সংশোধনী আইন পেশের সময় দেশভাগের প্রসঙ্গ তুলতে যাবেন কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? দেশভাগের
প্রসঙ্গই যদিবা উঠল, দ্বিজাতিতত্ত্বের কথাও উঠবেই। কারা চেয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা
আলাদা রাষ্ট্র? মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিল মুসলিম লিগ। আর RSS চেয়েছিল
হিন্দুদের জন্য রাষ্ট্র। চাহিদা পূরণ হয়েছে মুসলিম লীগের, তৈরি হয়েছে পাকিস্তান। অতৃপ্ত
চাহিদা নিয়ে বেঁচে আছে RSS। আজ তারা বদলা চাইছে। দেশভাগের বদলা। পাকিস্তানের বদলা।
পাকিস্তানের মতোই আরেকটা ধর্মীয় রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পথই কি তবে আমাদেরও গ্রহণ করতে
হবে?
প্রতিহিংসার
বিষ সুকৌশলে পাচার করা হয়েছে, হচ্ছে রক্তে রক্তে। প্রতিহিংসা, কিন্তু কার প্রতি? ইসলাম
ধর্মাবলম্বী যে মানুষগুলো নবগঠিত ‘ইসলামিক রাষ্ট্রে’ গিয়ে সংখ্যাগুরু হয়ে বাঁচার প্রলোভনকে
প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের প্রতি? ইসলাম ধর্মাবলম্বী যে মানুষগুলো সংখ্যালঘু হয়েও
ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের দেশ হিসেবে, তাঁদের প্রতি? যে মুসলমানেরা
মুসলিম লীগের অ্যাজেণ্ডাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, শিশু যেভাবে আঁকড়ে ধরে মায়ের আঁচল
সেইভাবে যারা আঁকড়ে ধরেছিলেন ভারতবর্ষকে, তাঁদের প্রতি? তাঁহাদের উত্তর প্রজন্মের প্রতি?
একটি
ধর্মের মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে সংশোধনী আইন। অন্য ছ’টি ধর্মের মানুষকে বোকা বানানোর
জন্যে। এবং মোট সাতটি ধর্মের বাইরের মানুষকে যাস্ট অস্বীকার করার তাগিদে। অথচ এতদিন
এঁরা সকলে মিলে চষেছেন এই দেশের মাটি। ফলিয়েছেন শস্য। গড়েছেন সম্পদ। গড়েছেন বিশ্বাস।
এক লহমায় এই সব বাতিল করে দেওয়া যায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে?
প্রধানমন্ত্রী
দেশবাসীকে পরামর্শ দিয়েছেন, সংসদের দুটো কক্ষ মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে সম্মান
করুন! বাহ্ রে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ’! রাস্তাজুড়ে লক্ষ মানুষ দিন রাত প্রতিবাদে,
বিশেষত ছত্র-যুবরা, রাস্তার অভিমতকে কবে সংসদ সম্মান জানাতে শিখবে?
প্রধানমন্ত্রী
বলছেন, দেশের ছাত্র-যুবরা বিভ্রান্তির শিকার। কিন্তু কে এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে?
২২শে
ডিসেম্বর ২০১৯ দিল্লীর রামলীলা ময়দানে দলীয় সভায় নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তাঁর সরকার
আসার পর থেকে আসামের বাইরে কোথাও NRC তৈরির কোনও কথা কেউ বলেইনি কখনও!
অথচ
গত ২০শে জুন ২০১৯ সংসদের যৌথ অধিবেশনে সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ পড়েছেন খোদ রাষ্ট্রপতি।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ভাষণটি আপনিও শুনেছেন, প্রধানমন্ত্রী! সেখানে সারাদেশে NRC বাস্তবায়নের
কথা বলেননি রাষ্ট্রপতি? আপনি ভালোই জানেন! স্পষ্ট সেসব মনেও আছে জানি, আজ ঢঙ করছেন।
নিশ্চিত মনে আছে, ২১শে নভেম্বর রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
বিবৃতি, "জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রক্রিয়া (NRC) সারা দেশে পরিচালিত হবে।"
কয়েকদিন পরে ৯ই ডিসেম্বর লোকসভাতেও এই কথা কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুদিন পরে
১১ তারিখ রাজ্যসভায় "নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৯" পেশ করেছেন। সেইদিন নিজেরই
দলের সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তর প্রশ্নের জবাবে ফের বলেছেন। প্রথমে CAB হবে, তারপর
NPR, শেষে NRC! স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিরোধীদের এই 'ক্রোনোলজি' বুঝিয়েছেন অমিত শাহই।
সংসদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে। এখানেই শেষ নয়! বাংলায় দিলীপ ঘোষ যেমন সারাদেশে NRC করে ২কোটি
মানুষকে দেশছাড়া করার হুমকি দিয়েছেন, বিজেপির
সর্বভারতীয় কার্যনির্বাহী সভাপতি মহাশয় জেপি নড্ডা সাহেবও তেমনই বলেছেন ১৯শে ডিসেম্বর
তারিখে।
আমরা বেচারা লোক, প্রধানমন্ত্রী/স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি
নাকি শাসক দলের রাজ্য/সর্বভারতীয় নেতাদের কার কথা ধরব আর ছাড়বই বা কার কথা? আমরা বিভ্রান্ত
হয়ে পড়লে অপরাধ নেবেন না, প্রাইম মিনিস্টার!
আমাদের বিভ্রান্ত করছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ডগুলো।
বিয়ের আগে ভোটার লিস্টে নাম উঠেছিল ‘রীতা সেন’। আধার কার্ড তৈরি হয়েছে বিয়ের পর। ততক্ষনে
মহিলার পদবী পালটে হয়ে গেছে দাস। আধার কার্ডের রীতা দাসের সাথে মিলছে না ভোটার কার্ডের
নাম। বিভ্রান্তি! ভোটার কার্ডের আমিনা খাতুনের সাথে মিলছে না আধার কার্ডের আমিনা বিবির
নাম। বিভ্রান্তি! রেশন কার্ডে নাম আছে দ্বিজ দাস, ভোটার লিস্টে দ্বিজপদ দাস। এখন এই
বাড়তি 'পদ'টা নিয়ে কোথায় যাবেন? বিভ্রান্তি! সুদীপ্ত-র নামের বানান এক কার্ডে শেষ হয়েছে
‘এ’ দিয়ে, অন্য কার্ডে ‘ও’ দিয়ে। বিভ্রান্তি!
রোজ পোস্টাপিসে লম্বা লাইন আধার কার্ড ঠিক
করানোর। সারাদিন ছুটে মরা ভোটার/রেশন কার্ড হাতে। আদালত চত্বরজুড়ে নাম, পদবী পরিবর্তনের
জন্য এফিটএফিট, হলফনামা, গিজগিজে ভিড়। কেউ জানে না ঠিক কবেকার কাগজ লাগবে NRC-তে। একাত্তরের
আগের নাকি একান্নর? ঠিক কোন কোন ডকুমেন্ট লাগবে? ভোটার, আধার, রেশন কার্ড কিংবা পাসপোর্ট
নাকি নাগরিকতার প্রমান নয়! তাহলে জন্ম সার্টিফিকেট, জমির দলিল? "দেশজুড়ে NRC হবে"
এমন একটা কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেও ঠিক কোন্ কোন্ ডকুমেন্ট লাগবে তা নির্দিষ্ট করে জানানো
হয়নি সরকারের তরফে। কবেকার কাগজ লাগবে সেটাও
স্পষ্ট করা হয়নি। স্বভাবতই এও এক বিষম বিভ্রান্তি!
আরও আছে। গভীরতর আরো কিছু বিভ্রান্তির পরিসর।
রাষ্ট্র যাকে জমির অধিকারই দেয়নি কখনও, কোত্থেকে সে নিয়ে আসবে জমির দলিল? হাজার বছর
ধরে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত মহিলারা, এখনও অনেকে, সম্পত্তির কোন মালিকানার
প্রমাণ দেবেন তাঁরা? এরাজ্যে সাতের দশকের শেষ কিংবা আটের দশকের শুরুতে যে খেতমজুর পেয়েছেন
একটুকরো জমি, একাত্তরের আগের দলিল সে পাবে কোথায় কিংবা একান্নর? কেউ বলছে চাকরির কাগজ
লাগবে, কেউ বলছে উচ্চশিক্ষার। রাষ্ট্র যাদের শিক্ষার অধিকারই দেয়নি, কীকরে পাবে তারা
উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট? যাদেরকে কোনোদিন চাকরিই দিল না সরকার, তাদের আবার চাকরির
প্রমানপত্র? ‘আদিবাসী’ নামে চিহ্নিত যাঁরা, তাঁরা যে দেশের আদি বাসিন্দাই সেটা প্রমাণ
করতে হবে কাগজ দেখিয়ে? এই এত এত বিভ্রান্তির দায় কে নেবে? রাষ্ট্র নেবে না?
বিভ্রান্তির
নতুন অধ্যায় NRP, ইতিমধ্যে যার গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করে দিয়েছে কেন্দ্র সরকার।
'ক্রোনোলজি' ভুলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এখন বলছেন, NRC-র সাথে এর কোনও সম্পর্কই নেই।
উনি কি ভুলে গেলেন, ২০০৩ সালে বিজেপিরই সরকার ছিল দেশে? সেবারও “নাগরিকত্ব আইন” সংশোধন
করেছিল তারা। আর সেই সংশোধনী আইনের ১৪এ ধারাতেই সারাদেশে NRC তৈরি করে ভারতীয় নাগরিকদের
’জাতীয় পরিচিতিপত্র’ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কেবল নির্দেশ দেওয়াই নয়, কীভাবে বাস্তবায়িত
হবে দেশব্যাপী NRC তা ঠিক করতে বিধি (Rule)-ও তৈরি করা হয় সেবছরই।
“Citizenship (Registration of Citizens
and Issue of National Identity Cards) Rules 2003”-এর মাধ্যমে NRC প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটি
নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ঘরে ঘরে লোক গণনা করে "জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি"
(NPR) প্রস্তুত করাই হবে "জাতীয় নাগরিক পঞ্জি" (NRC) তৈরির প্রাথমিক পদক্ষেপ।
এই যে জনসংখ্যা (population)-এর পঞ্জি তৈরি হবে, তার ভিত্তিতেই নানাবিধ দিক যাচাই করে
ভারতীয় নাগরিক (citizen)-দের পঞ্জি প্রস্তুত করা হবে। জাতীয় পঞ্জিকে ভাগ করা হবে রাজ্যপঞ্জি,
জেলাপঞ্জি, মহকুমাপঞ্জি, আঞ্চলিকপঞ্জিতে।
আঞ্চলিক
পঞ্জিকরণ আধিকারিকের হাতে কোন্ অলৌকিক ছাঁকনি থাকবে জানি না। তিনি প্রথম পঞ্জির
(NPR-এর) নামগুলি থেকে সেই ছাঁকনিতে ছেঁকে বাদ দেবেন 'সন্দেহজনক' লোকেদের। বাকিদের
নাম থেকে যাবে দ্বিতীয় তালিকায় অর্থাৎ বৈধ নাগরিকের পঞ্জি (NRC)-তে। এইভাবে তৈরি হবে
আঞ্চলিক স্তরের নাগরিক পঞ্জি। ক্রমান্বয়ে তৈরি হবে জাতীয় নাগরিকদের তালিকা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আজ যা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২০১৮-'১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন কিন্তু ঠিক তার
উল্টো কথাই জানাচ্ছে। এই প্রতিবদনের ১৫.৪০ নম্বর প্যারাগ্রাফে লেখা হয়েছে,
"...NPR হল ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব ইণ্ডিয়ান সিটিজেন (NRIC) তৈরির প্রথম পদক্ষেপ।"
তাহলে মিথ্যেটা কী বলছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক?
প্রসঙ্গক্রমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথাটাও
শুনে নেওয়া যাক। জে কিষাণ রেড্ডি মশাই বলছেন, "দেশব্যাপী NRC নিয়ে এখনও অবধি কোনও
প্রজ্ঞাপণ (নোটিফিকেশন) করাই হয়নি এবং কারো ভয় পাওয়া উচিৎ নয়।" উনি কি জানেন না
যে NPR-এর ভিত্তিতে NRC করার কথাটা ইতিমধ্যে বিধিবদ্ধ হওয়ায় নতুন করে দেশব্যাপী
NRC-র কোনও প্রজ্ঞাপণের দরকারই পড়ে না আর! NPR-এর নোটিফিকেশনের মাধ্যমেই সেটা করে দেওয়া
যায়! এবং সেইটেই করাও হয়েছে।
'জনগণনা পঞ্জি' বানিয়ে তার ভিত্তিতেই
যেহেতু তৈরি হবে নাগরিক পঞ্জি, ফলে NPR প্রস্তুতির কাজটিই এখন কেন্দ্র সরকারের কাছে
অগ্রাধিকার। যারা একে রুখতে চান, তাদের কাছেও স্বভাবতই অগ্রাধিকার পাবে NPR-কে আটকানোটা।
অথচ NPR-এর গোটা প্রত্রিয়াকে বাতিল করার কথা না বলে, এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন,
NPR-এর নির্দিষ্ট দু-একটি প্রশ্ন প্রত্যাহার করার! হায়, উনি কি ২০০৩-এর আইন ও বিধির
কথা জানেন না? সেসময় বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন না উনি? ছিলেন না সংসদের
গুরুত্বপূর্ণ সদস্য? তাহলে সব জেনে বুঝে শুরু থেকে NPR আর জনগণনাকে এক করে দেখাতে চাইছিলেন
কেন? কিছু কি লুকোনোর জন্য?
NPR নিয়ে ওনার দল পরিচালিত একাধিক পৌর
বোর্ডের আচরণ তেমন সন্দেহই উস্কে দিচ্ছে। কলকাতা কর্পোরেশনের মাসিক অধিবেশনেও (জানুয়ারি)
কার্যত NPR-এর ফিল্ড ওয়র্ক শুরুর প্রস্তাব পেশ হয়েছে তৃণমূলের তরফে। আর বিজেপির সমর্থনে
পাশও হয়ে গেছে। কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে NPR-এর আবেদনপত্রও আপলোড করে দেওয়া হয়েছিল তড়িঘড়ি
(যদিও পরে চাপে পড়ে সেটা তুলেও নিতে হয়)। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি কলকাতা কর্পোরেশনেরই ৭৫
নং ওয়ার্ডে নতুন আধার কার্ড বানানো ও সংশোধনের জন্যে ক্যাম্প বসে কর্পোরেশনের উদ্যোগে। সেখানে আরও ভয়ানক অভিযোগ ওঠে। এলাকার মানুষ কর্পোরেশনের
পাঠানো কর্মীদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন আবেদনপত্রের
উপরে থাকা থাকা "NPR নম্বর"-এর ঘর
পূরণ করার সময়। স্থানীয় বিধায়ক তথা পৌর ও নগরোয়ন্ন মন্ত্রী তথা কলকাতা কর্পোরেশনের
মেয়র ছুটে এসে পরিস্থিতি সামালানোর চেষ্টা করলেও, খড় দিয়ে চেপে রাখা যায়নি আগুন। সত্যকে
চেপে রাখা সবসময়ই কঠিন! সকলে তো দেখতেও পাচ্ছেন, রাজ্যজুড়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া
বিরাট বিরাট হোর্ডিংগুলোর বেশিরভাগেই CAA, NRC বিরোধিতার কথা থাকলেও লক্ষণীয়ভাবে অনুচ্চারিত
রয়েছে NPR-এর কথা। কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে এত হম্বিতম্বি করেও শেষ পর্যন্ত উনিই বা
বিভ্রান্ত করতে চাইছেন কেন রাজ্যের মানুষকে? এ প্রশ্নও আজ অস্বাভাবিক নয়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে এইখানে, কেন
এই বিপুল আয়োজন মানুষকে বিভ্রান্ত করার? কীসের ভয়ে? ঠিক কোন প্রশ্নগুলোকে চেপে দেওয়ার
জন্যে, ঠিক কোন দুশ্চিন্তাগুলোকে আড়াল করার তাগিদে?
যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবন জীবিকার সুরক্ষা
দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্র তার নাগরিকেদের ‘বোঝা’ বলেই মনে করবে। ঘাড় থেকে ঝেড়েই ফেলতে
চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষকে সে ‘সম্পদ’ মনে করবে না কখনও, কখনোই সযত্নে লালন করতে
চাইবে না। এটাই স্বাভাবিক। নিজের দেশেই আমরা আজ কীকরে যে ‘বোঝা’ হয়ে গেলাম? এই প্রশ্ন
যাতে না করি, তার জন্যই কি তবে এই তাবৎ প্রকল্প?
এ প্রকল্পের নাম দেওয়া যেতে পারে, "রাষ্ট্র
বনাম নাগরিক"। কেননা রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যুদ্ধ তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে। চ্যালেঞ্জের
মুখে ফেলে দিয়েছে তাদের অস্তিত্বকেই। জাত, ধর্ম, বর্ণ, বাসস্থান, ভাষা, লিঙ্গ, যৌন
পরিচিতি কিংবা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক অবস্থান নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের
অস্তিত্বকেই।
সঙ্গত
কারণেই এ মুহূর্তে প্রকল্পটির ফোকাল পয়েন্টে এসে পড়েছে "জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি"
(NPR)। এই প্রশ্নে সামান্যতম বিভ্রান্তির শিকার
হওয়া মানেই রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের অসহায় আত্মসমর্পণ। আমরা কি রাজি আছি তাতে?
রাষ্ট্র নিযুক্ত কোনও আধিকারিকের অলৌকিক ছাঁকনিতে
ছাঁকা হবে আমাদের, আমরা কি রাজি আছি? NPR-এ লিখে নিয়ে যাওয়া আমাদের তথ্যগুলো পরীক্ষা
করা হবে সরকারি দপ্তরে, পরীক্ষায় ফেইল করলে 'সন্দেহজনক' আর পাশ করলে 'বৈধ নাগরিক'!
এই দেশের সাথে আমার সম্পর্ক যে 'বৈধ', পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে সেটা প্রমাণ করতে হবে?
রাজি আছি? যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে 'আমার দেশ' বলার অধিকার পেতে কাউকে জবাবদিহি
করতে রাজি আছেন আপনি?
'রাষ্ট্র বনাম নাগরিক'-এর যুদ্ধে 'বিভ্রান্তি'র
বদলে 'আত্মমর্যাদা' শব্দটিকে নেওয়া ছাড়া নাগরিকদের সামনে আর অপশন নেই। আড়াআড়ি দাঁড়ানোর
ফুরসত নেই মুখোমুখি যুদ্ধের সময়।
*ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
*ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
NPR করতে এলে কি কি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে????
ReplyDeleteকোনো প্রশ্নেরই না। এনপিআর-এর কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না, এটাই স্লোগান হওয়া জরুরি। একটি প্রশ্নেরও জবাব দেওয়া মানেই এনপিআর প্রক্রিয়ায অংশ নিয়ে ফেলা। ফাঁদে ডান পা দেব না বাঁ পা দেব, প্রশ্নটি অর্থহীন। যে পাই এগিয়ে দিন না কেন, ফাঁদে পা দেওয়া হয়ে যাবে।
ReplyDelete