গদ্য: মানিক বৈরাগী


অর্জুনের কান্না



কাছারি ঘরে থাকতাম।কাছারি ঘর দোয়ানা বাঁশের তজ্জা করে বেডার ঘর।
ঘরের ছাঁট ছিল চাপালিশ কাটের, কাঠক্ষোদায় করা।সেই আদ্যিকালের বাড়ী। শুধুমাত্র দুটি জানালা কাটা ছিল, লোহার শিকদিয়ে কাটের। একটি পশ্চিমে আমার শিতান বরাবর। বড় জানালাটি দক্ষিণ দিকে। জানালার পাশে দুটি জমজ ছাতিম গাছ । পশ্চিমের জানালার পাশে দুটি আম ঘাছ ও কাটাল গাছ।

এখন আম্রমুকুল আর ছাতিম ফুলের উচ্ছল যৌবন। পুবের দরজার দু পাশে বেলি আর চাপা ফুলের গাছ।এই গাছ গুলি দ্বিজেশন শর্মা দেখলে দাদি বৃক্ষ বলতো।সেই দিদি মা মরে গেছে কত যুগ আগে।
ভর পূর্ণিমায় চাপা ও বেলি ফুল ফুটতো দিদিমা আসতো আমাকে সোহাগ করতে। তিনি আসতেন চন্দ্র দেশ থেকে।ঠিক একি ভাবে ছাতিম আর আম্র মুকুলের সময়, সাথেএক তাগড়া যুবক আসতো।সেই বলি খেলার মাঠে যেমন বার্মা মুলুক হাতি প্রকৃতি ও গয়ালের শিং উঁচিয়ে আসতো আমাকে তাড়াতে।
দিদিমাকে, কি অপরুপ লাগতো ততোবারই আমি তার প্রেমে পড়তাম। দিদি মা যখন আমার উস্কো কুস্কো চুল জৈতুন তেল মেখে মাথা আছড়ে দিতো তখোন ঐ বুনো গয়ালটি গুত গুত করত।

দিদি দাঁত খিলখিলিয়ে হাসতো,কত ঢং করে পানের পিক ফেলতো।সেই পানের পিকের একটি মাদকিয় গ্রাণ আছে।সেই গ্রাণে উম্মাতাল হতাম।আমি দিদি মাকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম।এভাবেই আমার স্বপ্ন ঘুমে ফজরের আজান হলে বাবা এসে ডাকতেন।ইকামুতসালাতা,হাইরুম মিনান নাউম।দিদি কে আর খোজে পাইনা। একদিন এক্কান্নবর্তী সংসারে ভাঙ্গল ধরলো। প্রায় প্রতি রাতে চাচা চাচি ও বিবাহিত ভাই ভাবিদের তুমুল ঝগড়া হতো চিল্লা চিল্লি হতো। হটাৎ সকালে চাচা চাচি ভাই ভাবিদের বিশাল বিশাল তর্ক  যুদ্ধ হলো। আর একদিন গলা ফাটা গাল মারামারি চিৎকার শুনে শুনে ফজর ইশরাকের নামাজ  পড়ে বাড়ী ফেরার পথে উঠানে দুই পক্ষ হাড়ু হাড়ু খেলার মতো একে অপর আয় আয় করে একদল আর এক দল কে ডাকছে। এভাবেই সংসার পরিবার সংঘের যৌথ চাষাবাদের যৌথ জীবন ভেস্তে গেলো। মুলত মানুষ প্রকৃতির অবাধ্য প্রাণী। মানুষ বড়ই ভোগী লোভী স্বার্থপর তার নিজের অজান্তেই। মানুষের ভেতর যতদিন প্রাকৃতিক স্বত্বা বিরাজমান থাকবে মানুষ ততোদিন ততোধিক মানবিক থাকবে প্রকৃতির মতো, সুন্দর থাকবে অরণ্যের মতো। আমি চিরকালই বুনো থাকতে চাই। আমি চিরকাল স্থির বয়ে চলা নদ থাকতে চাই। আমি চিরকাল প্রকৃতির মতো প্রাকৃতিজ থাকতে চাই। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খামখেয়ালিপনা হলো মানুষ। মানুষ আমাকে দিবেনা প্রকৃতি হতে; মানুষ প্রকৃতিরও এক অদ্ভুত খেয়ালির মানুষের জাত আমি। পৃথিবীর প্রথম এককোষি এমিবার প্রতি আমার চরম করুণা ও মায়া হয়। এককোষি ভাঙ্গনের ফলে মানুষ গোত্রে আমার জন্ম তন্তু। অথচ আমার বাস করার কথা ছিলো সাগর জলে। মানুষের কোলে পিঠে স্তন্য পান করে নিয়ত জ্বলছি। তবুও মনে পড়ে, মাকে মনে পড়ে। তবুও বাবাকে মনে পড়ে। মন কেউ কোনদিন দেখেনি। এটি একটি বায়বীয় স্বত্বা।

আমি যদি জলে থাকতাম মীনের মতো, কাসিমের মতো, আমার কোন মনই থাকতো না। কাসিম যেমন তার মা বাবা কে চিনেনা, জানেনা কে তার পিতা মাতা। চমৎকার এক দায়হীন  স্বাধীন জীবন। ঈশ্বর তাদের এক ভাই এক কন্যা করে পাঠিয়েছেন এ ধরায়। ঈশ্বরের কি অদ্ভুত খেয়ালি ও পরিহাস, কি নিষ্ঠুর পরীক্ষা নিরিক্ষা, তাদের ঔরসে গন্ডা গন্ডা সন্তান সন্ততি দিয়ে। তখন বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে বা শুরু হয়নি, পা কিস্তান কালিন সময়ে নিষিদ্ধ ছিল। তো আমাদের সকলের জন্ম পাকিস্তান কালিন সময়ে। বংশবৃদ্ধিই বংশের ঐক্যবদ্ধ শক্তি। জোত জমি দখলে রাখা, অধিক ফসল উৎপাদনের নিমিত্তে অধিক সন্তান উৎপাদন। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ।শ্রম দাও খাও আর সন্তান উৎপাদন করো। পালাপার্বণ এলে পিটাপুলি,খাও পান করো তালের রস, সোম রস আর নাছো। এটাও একপ্রকার প্রাকৃতিক জীবন উৎসবে মাতোয়ারা। তবুও আমি প্রকৃতির মতো একা হতেই জন্মেছিলাম। প্রতারিত হতেই জন্মেছিলাম।অর্জুন গাছ হয়ে জন্মেছিলাম।অর্জুন গাছই হয়ত আমার জন্মতন্তুর বৈশিষ্ট্য।

অর্জুন কাউকে কিছুই বলেনা, সে নীরব থাকে, ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। কাটে বাকল, কাটে শাখা প্রশাখা, ছিড়ে  কচি কচি আদুরে পাতা। কেউ কেউ মুকুলও নিয়ে যায়, কেউ নিয়ে যায় ফল। কেউ মাটি খোঁড়ে শিকড়। তবুও অর্জুন কিছুই বলে না। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলায় খেজুরের রস বের করার মতো কি নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে কেটে সাদা সাদা রক্ত বের করে নিয়ে যায়। তখন আমি চিৎকার করি, কেউ শুনেনা। অর্জুনের কান্না কেউ দেখে না। মা আমার কাছারি ঘরের দক্ষিণ জানালার পাশে একটি অর্জুন গাছ কি ভেবে রোপণ  করেছিলেন, এখন আমি টের পাই।

No comments:

Post a Comment

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com