বর্ণবিপর্যয় অথবা মূর্তির বিদ্যাসাগর
ঘটনা এমনই যে, আমাদের বিদ্যাসাগর মশাই-এর নয় নয় করে ২০০ বছর বয়স হয়ে গেল।এমত আবহে ভাবতে গর্ব হয় যে কেউ কেউ আজও বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করে।তবে মুশকিলটা হল এই যে গর্ব যেখানে আছে সেখানেই লজ্জারও বসতি। লজ্জা বিদ্যাসাগরের নয়, লজ্জা আমাদেরই যে আমরা বর্ণপরিচয় হওয়ার দুশো বছর পরেও বিদ্যাসাগরকে এতটুকুও সম্মান দিয়েছি কিনা সেটা নিজেরাই জানি না। তবে কাজ আমরা থামাইনি। আমরা খুব দায়িত্ব নিয়ে বিদ্যাসাগরের নামে রাস্তা করেছি,সেতু বানিয়েছি, স্কুল-কলেজ গড়েছি,গ্রন্থাগার বানিয়ে হাজার হাজার পুঁথি জমিয়েছি( সেইসব পুঁথি অবশ্য আমরা কিছুই পড়িনি,পড়লেও বুঝিনি,বুঝলেও ভাবিনি,ভাবলেও জীবনে সেসব ভুলেও প্রয়োগ করিনি।), দিকে দিকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি গড়েছি( যদিও বেশিরভাগ মূর্তিই কাকেদের বিষ্ঠাবর্জনে জর্জরিত), এবং নয় নয় করে এই দুশোবছরে অন্তত দুবার আমরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি মহাআড়ম্বরে ভেঙে ফেলে খুশির ধ্বজা ওড়াতেও ভুলিনি।
মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ যখন এসেই পড়ল তখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি নিয়ে একটু কথা বলে নিলে মন্দ হয় না। বিদ্যাসাগরবাবুর আবক্ষ,আকোমর কিংবা আপাদমস্তক মূর্তি আমরা সিমেন্ট-বালি সহযোগে,এমনকি কোথাও শ্বেত/কষ্টি পাথরে যারপরনাই উদ্যমে বানিয়েছি বটে কিন্তু আজ ২০০ বছরের ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে স্বীকার করতে বাধা নেই যে আমরা তাঁর মূর্তি মনের ভিতরে গড়ে তোলার কথা ভাবতেও ভুলে গেছি। এইসূত্র ধরেই বলে নেওয়া ভালো যে দু'দুবার বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতি ছলকে উঠেছিল। এই দুইবারের মূর্তিভাঙার প্রকার এবং প্রেক্ষিতকে একাসনে টেনে আনার কোন অর্থই আমি অন্তত দেখতে পাই না।
সাতের দশকে যখন উদ্দাম বিপ্লবের স্বপ্নে একদল ছাত্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল তখন তাদের সেই ভাঙার ভিতর নতুন করে গড়ার স্বপ্নই লুকিয়েছিল।তাই নকশালপন্থী সেই ছাত্ররা অকপটে স্বীকার করেছিল বা বলা যায় দায় নিয়েছিল বিদ্যাসাগরমূর্তির মস্তকছেদনের। তাদের এই দামালপনার সমর্থনে কলম ধরেছিলেন তাদের লড়াকু নেতা চারু মজুমদার স্বয়ং। তিনি জানিয়েছিলেন যে, বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে তখন তাঁরা একটা ফেটিশ হিসাবে দেখছেন। তাঁদের আদর্শকে কেউ সমর্থন করুক বা না-ই করুক সেই ঘটনা কখনওই যে ভ্যাণ্ডালিসম ছিল না এইকথার সমর্থনে চারু মজুমদারের সেইসময়কার অবস্থানকে বুঝে নেওয়া যেতেই পারে।চারুবাবু তখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি মনে করেছেন যে,বিদ্যাসাগর প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তিকে সমর্থনই করেছিলেন। মহাবিদ্রোহের সময় বিদ্যাসাগর যে তাঁর সংস্কৃত কলেজে গোরাপল্টনদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ঘটনার উল্লেখ করে চারুপন্থী নকশালরা মূর্তিভাঙার স্বপক্ষে বিবৃতি দেন। এই ঘটনার আরও একটা সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায় নারায়ণ সান্যালের একটা স্মৃতিচারণমূলক গদ্যে। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ছাত্রের উল্লেখ করেন। সেই ছেলেটি লেখককে বলেছিল যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি যে ছেলেটি ভেঙেছিল সে তাকে চেনে। ছেলেটি কলেজে ভর্তি হবার আগে স্কুললিভিং পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল।এই তথ্যের থেকেও যেটা মজার তথ্য সেটা হল ওই স্কুললিভিং পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নে তাদের যে প্রবন্ধগুলির মধ্যে থেকে যেকোনো একটির উত্তর দিতে বলা হয়, সেই প্রবন্ধগুলির একটি ছিল 'বিদ্যাসাগর '। ছেলেটি বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধেই প্রবন্ধ লিখেছিল এবং তার লেখার জন্য সে পরীক্ষায় সেই বছরের সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল। এরপরেও সে বিদ্যাসাগরের মূর্তি নিজে হাতে ভাঙে তার কারণ তার বা তাদের সকলেরই দাবি ছিল যে মূর্তি বানিয়ে বিদ্যাসাগরের ভুলগুলোকে তো ঢেকে দেওয়া যায়ই না বরং তাঁর গঠনমূলক কাজগুলোকেও বেমালুম ভুলে থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকেই কলুষিত করা হয়েছে। হে পাঠক, আপনি এই ভাবনার বিরোধিতা করতেই পারেন, কিন্তু এই ধারণার বীজে একধরণের আদর্শগত অবস্থান যে ছিল সেটা অস্বীকার করা যায় না।
সাতের দশকে যখন উদ্দাম বিপ্লবের স্বপ্নে একদল ছাত্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল তখন তাদের সেই ভাঙার ভিতর নতুন করে গড়ার স্বপ্নই লুকিয়েছিল।তাই নকশালপন্থী সেই ছাত্ররা অকপটে স্বীকার করেছিল বা বলা যায় দায় নিয়েছিল বিদ্যাসাগরমূর্তির মস্তকছেদনের। তাদের এই দামালপনার সমর্থনে কলম ধরেছিলেন তাদের লড়াকু নেতা চারু মজুমদার স্বয়ং। তিনি জানিয়েছিলেন যে, বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে তখন তাঁরা একটা ফেটিশ হিসাবে দেখছেন। তাঁদের আদর্শকে কেউ সমর্থন করুক বা না-ই করুক সেই ঘটনা কখনওই যে ভ্যাণ্ডালিসম ছিল না এইকথার সমর্থনে চারু মজুমদারের সেইসময়কার অবস্থানকে বুঝে নেওয়া যেতেই পারে।চারুবাবু তখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি মনে করেছেন যে,বিদ্যাসাগর প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তিকে সমর্থনই করেছিলেন। মহাবিদ্রোহের সময় বিদ্যাসাগর যে তাঁর সংস্কৃত কলেজে গোরাপল্টনদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ঘটনার উল্লেখ করে চারুপন্থী নকশালরা মূর্তিভাঙার স্বপক্ষে বিবৃতি দেন। এই ঘটনার আরও একটা সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায় নারায়ণ সান্যালের একটা স্মৃতিচারণমূলক গদ্যে। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ছাত্রের উল্লেখ করেন। সেই ছেলেটি লেখককে বলেছিল যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি যে ছেলেটি ভেঙেছিল সে তাকে চেনে। ছেলেটি কলেজে ভর্তি হবার আগে স্কুললিভিং পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল।এই তথ্যের থেকেও যেটা মজার তথ্য সেটা হল ওই স্কুললিভিং পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নে তাদের যে প্রবন্ধগুলির মধ্যে থেকে যেকোনো একটির উত্তর দিতে বলা হয়, সেই প্রবন্ধগুলির একটি ছিল 'বিদ্যাসাগর '। ছেলেটি বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধেই প্রবন্ধ লিখেছিল এবং তার লেখার জন্য সে পরীক্ষায় সেই বছরের সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল। এরপরেও সে বিদ্যাসাগরের মূর্তি নিজে হাতে ভাঙে তার কারণ তার বা তাদের সকলেরই দাবি ছিল যে মূর্তি বানিয়ে বিদ্যাসাগরের ভুলগুলোকে তো ঢেকে দেওয়া যায়ই না বরং তাঁর গঠনমূলক কাজগুলোকেও বেমালুম ভুলে থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকেই কলুষিত করা হয়েছে। হে পাঠক, আপনি এই ভাবনার বিরোধিতা করতেই পারেন, কিন্তু এই ধারণার বীজে একধরণের আদর্শগত অবস্থান যে ছিল সেটা অস্বীকার করা যায় না।
এই ঘটনার আলোকে দ্বিতীয় ভাঙচুরের ঘটনাটি দেখলেই বাস্তবার নির্মম অসহায়তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলের একটি মিছিল চলাকালীন সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর কলেজের সম্মুখস্থ বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি কে বা কারা ভেঙে দেয়। এইবারে কিন্তু যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের কেউই এই কর্মের দায়স্বীকার করেনি। বরং তারা মূর্তিভাঙার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট যে কোন আদর্শের তাগিদে নয় স্রেফ মূর্খতাই এবারের ভ্যাণ্ডালিসমের কারণ। এই দায় যে শুধু ভ্যাণ্ডালিস্টদের তা-ই নয়,একটু ভেবে দেখলে বুঝবেন এ দায় আমার,আপনার, সবার। আমরাই এমন একটা বন্ধ্যা সমাজের জন্ম দিয়েছি, যে সমাজ বিদ্যাসাগরকে না জেনেই তার মূর্তিকে ধুলোয় টেনে নামানোর নির্বোধ দুঃসাহস দেখাতে পারে।
যারা অশিক্ষিত নির্বুদ্ধিতায় ঈশ্বরচন্দ্রকে ধুলোয় লুটিয়েছে তাদের নিয়ে আলোচনা চলুক, কিন্তু যারা অতিশিক্ষার আড়ম্বরে আমাদের অজান্তেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে টুকরো করে ফেলেছেন তাঁদের নিয়ে আসুন একটু সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরে নিই।
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে আমরা যে কখন ৯ নামের বর্ণটিকে অব্যবহার্য ভেবে বসলাম সে নিয়ে গবেষণা চলতে পারে, তবে কেন ৯ বাদ গেল সেই বিষয়ে আমরা যে প্রায় সকলে সহমত হয়ে বসে আছি এই বিষয়টাই আমাকে বেশ অবাক করে।আমার অবাকবিস্ময়ের কারণ প্রথমত এটাই যে বিদ্যাসাগর মশাই-এর ভাবনাকে পালটে ফেলে আমরা কি তাঁর চিন্তাক্রমের ত্রুটি নির্ণয় করতে চাইলাম? ত্রুটি শব্দটি মনে আসা স্বাভাবিক, কারণ সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে কোন বর্ণগুলো নেওয়া হবে না সে সম্পর্কে বিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয় প্রথমভাগে স্পষ্ট মতামত জানিয়েছেন।
' বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ প্রচারিত হইল। বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ র্ঋকার ও দীর্ঘ ৯ কারের প্রয়োগ নাই ; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। ' এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে বিদ্যাসাগর জানতেন যে, বাংলাভাষায় দীর্ঘ ৯ না থাকলেও, ৯ আছে।তাহলে এই ৯ এই ২০০ বছরে কোথায় ছিল জানলেও সে কোথা থেকে কিভাবে উধাও হয়ে গেল সে ইতিহাস আমার আপনার জানা নয়। তবু অনুমান করতে পারি যে ৯ বাংলাভাষার ঠিক কোথায় আছে এটা নাজানার কারণে অথবা জেনেও সেই টেক্সটকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েই কিছু নব্যভাষাবিদ ৯কে বর্ণমালা থেকে বাদ দিয়ে দিলেন।তাই এতক্ষণ ধরে ৯ বলে যে বর্ণটি আমি লিখে চলেছি, সেটা বাংলা বর্ণমালার থেকে মুছে যাওয়ায় আদতে সেটা ৯এর লিখিত রূপ নয়। এটা বড় কোন সমস্যা হয়তো নয়,কিন্তু বড় সমস্যাটা হল, ৯ বর্ণটি পাওয়া যায় ভারতীয় তন্ত্রসাধনার বিভিন্ন মন্ত্রে। এই জোর করে লুপ্তবর্ণে পর্যবসিত করে দেওয়া ৯ ধ্বনিকে বাংলাভাষার পাঠক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী আর মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় খুঁজে পাবেন। তখন তাঁরা নিশ্চয়ই অনুভব করবেন যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে আজ যারা নিন্দায় সোচ্চার তাঁরা জেনে বা অজান্তেই বিদ্যাসাগরের মূর্তির পলেস্তারা মন থেকে খসিয়ে দিয়েছেন। তবে কী প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের ধুয়ো তুলে যারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় চেপে বসতে চাইছেন তাঁরা বিদ্যাসাগরকে মনে রাখবেন! কখনওই নয়। এরা যদি মূর্তির পলেস্তারা খসায় তো ওরা গোটা মূর্তিটাকেই পাথরে খোদাই করে মন থেকে বিদ্যাসাগরের মনোময় মূর্তির সমূলে উৎপাটন করতে চায়।
বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেবদেবীপ্লুত তথাকথিত হিন্দুত্বের কোন যোগাযোগই যে ছিল না! তিনি তেত্রিশ কোটি দেবতার একটি দেবেও বিশ্বাসী ছিলেন না।তিনি অদ্বৈতবাদী। মানবতার উপাসক। মানুষের মধ্যেই তাঁর মুক্তি। তিনি আমাদের জন্য সমস্ত ছেড়েছেন বলেই আমাদের শহুরে সমাজে শেষজীবনে তাঁর দম আটকে এসেছে। জীবনোপান্তে তিনি আমাদের এই নাগরিক গর্বিত সভ্যসমাজ থেকে দূরে তথাকথিত অসভ্য উপজাতিদের মধ্যে বেঁচে থেকে শ্বাস নিতে চেয়েছেন।
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে আমরা যে কখন ৯ নামের বর্ণটিকে অব্যবহার্য ভেবে বসলাম সে নিয়ে গবেষণা চলতে পারে, তবে কেন ৯ বাদ গেল সেই বিষয়ে আমরা যে প্রায় সকলে সহমত হয়ে বসে আছি এই বিষয়টাই আমাকে বেশ অবাক করে।আমার অবাকবিস্ময়ের কারণ প্রথমত এটাই যে বিদ্যাসাগর মশাই-এর ভাবনাকে পালটে ফেলে আমরা কি তাঁর চিন্তাক্রমের ত্রুটি নির্ণয় করতে চাইলাম? ত্রুটি শব্দটি মনে আসা স্বাভাবিক, কারণ সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে কোন বর্ণগুলো নেওয়া হবে না সে সম্পর্কে বিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয় প্রথমভাগে স্পষ্ট মতামত জানিয়েছেন।
' বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ প্রচারিত হইল। বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ র্ঋকার ও দীর্ঘ ৯ কারের প্রয়োগ নাই ; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। ' এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে বিদ্যাসাগর জানতেন যে, বাংলাভাষায় দীর্ঘ ৯ না থাকলেও, ৯ আছে।তাহলে এই ৯ এই ২০০ বছরে কোথায় ছিল জানলেও সে কোথা থেকে কিভাবে উধাও হয়ে গেল সে ইতিহাস আমার আপনার জানা নয়। তবু অনুমান করতে পারি যে ৯ বাংলাভাষার ঠিক কোথায় আছে এটা নাজানার কারণে অথবা জেনেও সেই টেক্সটকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েই কিছু নব্যভাষাবিদ ৯কে বর্ণমালা থেকে বাদ দিয়ে দিলেন।তাই এতক্ষণ ধরে ৯ বলে যে বর্ণটি আমি লিখে চলেছি, সেটা বাংলা বর্ণমালার থেকে মুছে যাওয়ায় আদতে সেটা ৯এর লিখিত রূপ নয়। এটা বড় কোন সমস্যা হয়তো নয়,কিন্তু বড় সমস্যাটা হল, ৯ বর্ণটি পাওয়া যায় ভারতীয় তন্ত্রসাধনার বিভিন্ন মন্ত্রে। এই জোর করে লুপ্তবর্ণে পর্যবসিত করে দেওয়া ৯ ধ্বনিকে বাংলাভাষার পাঠক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী আর মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় খুঁজে পাবেন। তখন তাঁরা নিশ্চয়ই অনুভব করবেন যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে আজ যারা নিন্দায় সোচ্চার তাঁরা জেনে বা অজান্তেই বিদ্যাসাগরের মূর্তির পলেস্তারা মন থেকে খসিয়ে দিয়েছেন। তবে কী প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের ধুয়ো তুলে যারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় চেপে বসতে চাইছেন তাঁরা বিদ্যাসাগরকে মনে রাখবেন! কখনওই নয়। এরা যদি মূর্তির পলেস্তারা খসায় তো ওরা গোটা মূর্তিটাকেই পাথরে খোদাই করে মন থেকে বিদ্যাসাগরের মনোময় মূর্তির সমূলে উৎপাটন করতে চায়।
বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেবদেবীপ্লুত তথাকথিত হিন্দুত্বের কোন যোগাযোগই যে ছিল না! তিনি তেত্রিশ কোটি দেবতার একটি দেবেও বিশ্বাসী ছিলেন না।তিনি অদ্বৈতবাদী। মানবতার উপাসক। মানুষের মধ্যেই তাঁর মুক্তি। তিনি আমাদের জন্য সমস্ত ছেড়েছেন বলেই আমাদের শহুরে সমাজে শেষজীবনে তাঁর দম আটকে এসেছে। জীবনোপান্তে তিনি আমাদের এই নাগরিক গর্বিত সভ্যসমাজ থেকে দূরে তথাকথিত অসভ্য উপজাতিদের মধ্যে বেঁচে থেকে শ্বাস নিতে চেয়েছেন।
*ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
খুব চমৎকার, যুক্তিনিষ্ঠ লেখা। এই সময়ের ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য।
ReplyDelete