বিদ্যাসাগরের ছন্দবোধদিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
এ গদ্যের শিরোনামটি পড়ে কোনো পাঠকের যদি খটকা
লাগে, কিংবা
নিতান্তই ‘স্টান্ট’ বলে মনে হয়, তাঁকে দোষ
দেওয়া যাবে না। কারণ,
ছন্দ বিষয়টি কবিতা বা পদ্যের সঙ্গেই জড়িত। আর বিদ্যাসাগর না ছিলেন কবি, না ছান্দসিক। উনিশ
শতকের বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে তিনি একজন ব্যতিক্রমী লেখক যিনি কখনও কবিতা লেখেননি।
আরও আশ্চর্যের, সংস্কৃত
সাহিত্যশাস্ত্রের অবিসংবাদিত পাঠক ও অনুবাদক হয়েও সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে তিনি ছিলেন
নীরব। বিটন সোসাইটির সভাঘরে পঠিত তাঁর
বিখ্যাত রচনা ‘সংস্কৃত
ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে (১৮৫৪) সেটি
প্রথম কোনো ভারতীয়ের রচিত সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসের মর্যাদা পায়। সেই গ্রন্থে
যমক ও অন্যান্য অলংকারের প্রসঙ্গ এমনকী ‘নৈষধচরিত’ প্রসঙ্গে
শ্রীহর্ষের অলংকার ব্যবহারের ভুটি সংক্রান্ত কিংবদন্তীর উল্লেখ ( বিদ্যাসাগর
রচনাবলী, সম্পা--
সুবোধ চক্রবর্তী, কামিনী
প্রকাশালয়, পৃষ্ঠা-৮৬
) থাকলেও কোনো কবির ছন্দ বিষয়ে একটি বাক্যও নেই। অথচ, বিদ্যাসাগরের
সমগ্র জীবন, কীর্তি
ও সৃষ্টির দিকে ফিরে তাকালে, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, কী এক আশ্চর্য ছন্দসুষমায় বাঁধা
সবকিছু। তবু এই গদ্যের শিরোনামটি ‘ছন্দ’ শব্দের সেই
দার্শনিক অর্থ-তাৎপর্যে ব্যবহৃত নয়। ছন্দ বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি, সেই
প্রোজোডি অর্থেই এই শিরোনাম। তাঁর জীবন ও
সামাজিক কীর্তিগুলিকে বাদ দিয়ে কেবল তাঁর সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ-বিষয়ক রচনাগুলির যদি
কোনো সামান্য গুণ থাকে তা এই ছন্দবোধ। পরিব্যাপ্ত
ছন্দবোধ তথা ছন্দচেতনাই বিদ্যাসাগরকে বাংলার সাহিত্য ও শিক্ষার জগতে অনন্য করেছে।
বিষয়টি শুরু করা যাক তাঁর
সর্বাধিক প্রচারিত ও পঠিত রচনা ‘বর্ণ পরিচয়’ নামের প্রাইমারটি দিয়ে। বিদ্যাসাগর
শিশুপাঠ্য এই বইটিতে বাংলা বর্ণের যে তালিকা দিয়েছিলেন তা এই সেদিন পর্যন্ত
অপরিবর্তিত ছিল। এখানে স্বরবর্ণমালায় বাংলায়
ব্যবহার নেই এই কারণে দীর্ঘ ঋ এবং দীর্ঘ ৯ বাদ দিয়েছেন। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ-এর
বিজ্ঞাপনে লিখেছেন-- ‘বাঙ্গালা
ভাষায় দীর্ঘ ঋকার ও দীর্ঘ ৯কারের প্রয়োগ নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত
হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, অনুস্বর ও
বিসর্গ স্বরমধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; এজন্য ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের
মধ্যে পতিত হইয়াছে। ( বিদ্যাসাগর রচনাবলী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা--১০১১)।
এখন, সবিশেষ
অনুধাবন করে তো তিনি এও দেখেছেন যে, বাংলা ভাষায় ৯-এর কোনো ব্যবহার নেই। অথচ, ৯ বর্ণটিকে
তিনি স্বরবর্ণমালায় রেখে দিয়েছেন। প্রতিটি বর্ণের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন বর্ণটি
প্রথমে আছে এমন কোনো শব্দ দিয়ে। কিন্তু ৯ এর
ব্যবহার দেখাতে গিয়ে লিখেছেন ‘লিচু’। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ৯এর কোনো
ব্যবহার নেই জেনেও কেন তিনি বর্ণমালায় সেটিকে রাখলেন? ৯ প্রসঙ্গে
তিনি কিছুই বলেননি। একে সংস্কৃতের পিছটান বললে তাঁর ওপর
অবিচার করা হবে। কারণ পিছটান ছিল না বলেই তিনি অন্য পরিবর্তনগুলি অবলীলায় করেছেন।
এমনকী বর্ণপরিচয়ের ষষ্টীতম সংস্করণে কর, খল, ঘট, জল ইত্যাদি শব্দকে শিশুরা যেন
অকারান্ত না পড়ে হলন্ত হিসেবে পড়ে, শিক্ষক মশায়দের সে বিষয়ে নির্দেশ
দিচ্ছেন। অথচ, ৯
বর্ণটির জন্য তিনি একটিও বাক্য খরচ কললেন না।
কেন ৯ বর্ণটিকে তিনি
স্বরবর্ণমালায় রেখে দিলেন,
তার একমাত্র উত্তর হতে পারে ছন্দবোধ। তুলনা করা
যাক বিদ্যাসাগর প্রদত্ত ও অধুনা প্রচলিত স্বরবর্ণমালার :
১. অ আ ই ঈ
উ ঊ
ঋ ৯
এ ঐ
ও ঔ
২. অ আ ই ঈ
উ ঊ
ঋ
এ ঐ
ও ঔ
বিদ্যাসাগর প্রদত্ত
স্বরবর্ণমালা দিব্যি চারের ছকে বাঁধা। কিন্তু
অধুনা-প্রচলিত ৯-বিহীন স্বরবর্ণমালা কেমন যেন খোঁড়া। বিদ্যাসাগর
প্রাগমাটিক, কিন্তু
ছন্দহীন একটি বর্ণমালা শিশুদের হাতে তুলে দিতে পারেননি। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে
তাঁর ‘জল
পড়িতেছে পাতা নড়িতেছে’--
বালক রবীন্দ্রনাথের মনে শৈশবের মেঘদূত হয়ে উঠেছিল। জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন:
‘তখন
‘কর
খল’ প্রভৃতি
বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন
পড়িতেছি, ‘জল
পড়ে পাতা নড়ে’। আমার
জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা। (রবীন্দ্র
রচনাবলী, বিশ্বভারতী
সুলভ সংস্করণ, নবম
খন্ড, পৃষ্ঠা
৪১২) বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের
ঘটমান বর্তমান রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে নিত্য বর্তমানের রূপ পেয়ে কবিতার ধুপছায়া
রচনা করেছে। কবিতা না লিখেও রবীন্দ্রনাথের শৈশব
স্মৃতিতে বিদ্যাসাগর ‘আদিকবি’।
বিদ্যাসাগর যথার্থই কবি, কেবল তাঁর
কবিতৃপ্রকাশের মাধ্যমটি ছিল গদ্য। তিনি বাংলা গদ্যের আদিকবি। বিষয়টির
একটি প্রতীকী নিদর্শন রয়েছে তাঁর ‘প্রভাবতী সম্ভাসণ’ নামক
রচনায়। বন্ধুকন্যা বালিকা প্রভাবতীর মৃত্যুতে শোকার্ত বিদ্যাসাগর তাঁর শোক
ব্যক্ত করেছেন এই করুণ রসাত্মক ব্যক্তিগত গদ্যটিতে। বাঙালির
পক্ষে এ স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক। বাঙালি শোকার্ত হলে হাতে কলম তুলে নেবে এ অতি
স্বাভাবিক। কিন্তু সে কলম থেকে কবিতা আর গানই নি:সৃত হবে-- এও যেন নির্ধারিত।
বিদ্যাসাগর এলিজি লিখলেন। কিন্তু সে এলিজি গদ্যে। রচনাটির
শ্রেণি নির্দেশ করা হয় ‘গদ্য এলিজি’ নামে।
তবে কি গদ্যের মধ্যেই তিনি
সন্ধান ও আবিস্কার করেছেন পদ্যের মোহিনী শক্তি? নাকি ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়ের মতো
তাঁরও অবচেতনে ছিল এমন কথা যে গদ্যেই কবিত্ব ঢের বেশি প্রকাশ পায়? রবীন্দ্রনাথের
একটি চিঠিতে ঠাকুরদাসের এই অভিমতের সন্ধান পাই আমরা যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “তার
(ঠাকুরদাসের) বিশ্বাস,
আমার গদ্যে পদ্যের চেয়ে ঢের বেশি কবিত্ব প্রকাশ পায় এবং সেইটেই তার মতে
স্বাভাবিক। কেবল তাই নয়,
এই একই চিঠি থেকে জনতে পারি, ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, একদিন গদ্য
এমন সুন্দর হয়ে উঠবে যেদিন পদ্যভাষার আর প্রয়োজনই থাকবে না। কথাটির সারবত্তা
আমরা এখন বুঝতে পারি। অনুমান করতে দোষ কোথায়, বিদ্যাসাগর, যিনি
সংস্কৃত সাহিত্যের মুক্তমনা রসিক ছিলেন, যিনি বাণভট্টর কাদম্বরীর মতো
কথাকাব্যের অন্তঃপুরটিকে চিনেছিলেন অলোকসামান্য মেধা ও সহৃদয়তার আলোয়, তিনি একথা
জানতেন।
তো, কী ছিল তাঁর
গদ্যশিল্পের চাবিকাঠি ?
প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরকে
বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ (বিদ্যাসাগর
চরিত, চারিত্রপূজা, ১৩০২)। বাংলা
গদ্যের বিশৃঙ্ক্ষল জনতাকে সুশৃক্ষল সৈন্যসজ্জায় রূপান্তরের কীর্তিটি তাঁর মতে
বিদ্যাসাগরের। সেই কীর্তির কারখানাঘরটির দিক
নির্দেশের কাজটিও করেছেন রবীন্দ্রনাথই। উদ্ধৃত করা
যাক রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ: ‘বাংলাভাষাকে পূর্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত
করিয়া, তাহার
পদগুলির মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করি বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে
কেবলমাত্র সর্বপ্রকার-ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে
শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। লক্ষ্যণীয়, গদ্য
প্রসঙ্গে ‘পদ’ শব্দটির ব্যবহার। ‘পদগুলির
মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন’ ভাষাকে যে জীবিতপ্রায় গতি দিল তা-ই বিদ্যাসাগরের প্রাথমিক
অবদান। আমরা তাঁর প্রথম রচনা ‘বাসুদেবচরিত’ পাইনি, কিন্তু প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বেতাল
পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) বাংলা গদ্যের যে কাঠামো নিয়ে এল, তা
রবীন্দ্রনাথ-ব্যবহৃত ‘শিল্প’ শব্দটির
যোগ্য দাবিদার। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করতেই হয় পূর্বসূরী অক্ষয়কুমার দত্তের অবদান।
বাংলা গদ্যে যতিচিহ্ন ব্যবহার শুধু নয়, যতিচিহ্নকে পাঠনির্দেশিকা হিসেবে
প্রথম ব্যবহারের কৃতিত্বও অক্ষয়কুমারের। ড. নবেন্দু
সেন তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘গদ্যশিল্পী’ অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ডিসেম্বর, ১৯৭১, জিজ্ঞাসা, কলিকাতা)
গ্রন্থে বলেছেন যে, অক্ষয়কুমারের
গদ্য রচনাগুলি তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত হওয়ার আগে সভায় পঠিত হত। এ কারণেই তাঁর
গদ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল ভাষণকলা, যা তাঁর গদ্য রচনাকে প্রভাবিত করেছে (পৃ--১৪৯)। কথাটির
সূত্র ধরেই বলা যায়,
উনিশ শতকের আখ্যান সাহিত্য একই সঙ্গে ছিল শ্ৰব্য ও পাঠ্য। বাড়িতে
বাড়িতে এক সঙ্গে বই পড়ার,
অর্থাৎ, এক
জনের পড়া ও অন্য কয়েক জনের শোনার রীতিটি ছিল সর্বত্র। আমাদের মনে পড়বেই ‘নীলদর্পন’ নাটকে
সৈরিন্ধীর উক্তি-- ‘ছোট
বউ বসি, আমি
আছি, বিদ্যাসাগরের
বেতাল শুনবো। ফলে পাঠনির্দেশিকা হিসেবে হ্রস্বতির
ব্যবহার বিদ্যাসাগরের গদ্যে আরও সুক্ষ ও সুচারু হল ।
কিন্তু, পাঠ
নির্দেশের এই বিষয়টি কেবল অর্থের প্রয়োজনে নয়, বরং অর্থ-নিরপেক্ষ একটি প্রয়োজন বিদ্যাসাগরকে
বেশি তাড়িত করেছিল বলেই মনে হয়। সেই প্রয়োজনটি হল ছন্দের। রবীন্দ্রনাথের
উক্তি স্মরণ করি আবার: গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধূনিসামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া
তাহার গতির মধ্যে একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং
সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া, বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান
করিয়াছেন। (‘বিদ্যাসাগরচরিত’, প্রাগুক্ত, পৃ.--৭৬৮)। কেমন
এই অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত?
বেতাল পঞ্চবিংশতি’র
তৃতীয় উপাখ্যান থেকে শেষ (পঞ্চবিংশতি) উপাখ্যান পর্যন্ত প্রতিটি উপাখ্যান শুরু
হচ্ছে এভাবে :
‘বেতাল কহিল, মহারাজ!’
যেন, গল্প নয়, কাব্য শুরু
হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, ১০ মাত্রার
মিশ্রকলাবৃত্তের চাল। কিন্তু, বিশুদ্ধ কাব্যছন্দকে ‘অনতিলক্ষ্য করে তুলল মাঝখানের অর্থতি
জ্ঞাপক কমা (,) চিহ্নটি।
পরবর্তীকালে একেই তো রবীন্দ্রনাথ বলবেন ‘গদ্যে পদ্যের রঙ লাগানো’।
এবার ঢুকে পড়া যাক আখ্যানের
ভেতর :
‘প্রিয়
বয়স্যের উপদেশবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, রাজকুমার কহিলেন, সখে! আমি
যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিয়াছি, তখন আমার হিতাহীতচিন্তা ও সুখ-দুঃখ বিবেচনা নাই। প্রতিজ্ঞা
করিয়াছি, মনোরথ
সম্পন্ন না হইলে, জীবন
বিসর্জন দিব। ( প্রথম উপাখ্যান, বিদ্যাসাগরচরিত, পৃ-১৩)
অর্থতি বা ছেদকে ছন্দ্যতি বলে গণ্য করলে প্রথম
বাক্যটিতে তিনটি পর্ব,
যথাক্রমে ২১, ১০
ও ২। দ্বিতীয় বাক্যে যথাক্রমে ১৯, ১২, ৯ ও ২। তৃতীয়
বাক্যে যথাক্রমে ৭, ১১
ও ৯। দেখা যাচ্ছে তিনটি বাক্যের দুটিতে পর্বের মাত্রসংখ্যা পদ্যের মতো অতি
নিরুপিত নয়, আবার
সর্বত্র গদ্যের অনিয়ত্রিত পর্বও নেই। রয়েছে গদ্য কবিতার অনতি নিয়ন্তিত পর্বের
সঙ্গে গদ্যের অনিয়ন্ত্রিত পর্বের মিশ্রন। অর্থাৎ, সাম্য নয়, এক ধরণের
সমঞ্জস্য। এই সামঞ্জস্যই গদ্যশিল্পের প্রাণ। আর এ যে কেবল তাঁর কথা গদ্যের চরিত্র
তা নয়, তাঁর
যাবতীয় রচনাই এই অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোতের নানা মাত্রিক ব্যবহারে বিশিষ্ট।
দৃষ্টান্ত :
১. ব্যক্তিগত গদ্য
: ‘বৎসে
প্রভাবতী ! তুমি দয়া,
মায়া, মমতা
ও বিবেচনায় বিসর্জন দিয়া,
এ জন্মের মত, সহসা, সকলের
দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছ। কিন্তু আমি অনন্যচিত্ত হইয়া, অবিচলিত
স্নেহভরে তোমার চিন্তায় নিরন্তর এরূপ নিবিষ্ট থাকি যে, তুমি, এক
মুহূর্তের নিমিত্ত, আমার
দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতে পার নাই। (প্রভাবতীসম্ভাসন, বি. সা. র.
প্রাগুক্ত পৃ-- ৩৪০)
২. ব্যক্তিগত চিঠি
: আপনার কন্যার বিবাহ বিষয়ে অনেক বিবেচনা করিয়াছি, কিন্তু আপনাকে কী পরামর্শ দিব, কিছুই স্থির
করিতে পারি নাই। ফলকথা এই যে, এরূপ বিষয়ে
পরামর্শ দেওয়া কোনও ক্রমেই সহজ ব্যাপার নহে। (
রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠি, ঐ,
পৃ-- ৪১৭)।
৩. প্রবন্ধ : ‘সংস্কৃত
আলঙ্কারিকেরা সাহিত্যশাস্ত্রকে দুই প্রধান ভাগে বিভক্ত করেন, শ্ৰব্যকাব্য
ও দৃশ্যকাব্য। তাঁহারা এই উভয় বিভাগের মধ্যেই সমুদয় সাহিত্যশাস্ত্র সমাবেশিত
করিয়াছেন। শ্ৰব্যকাব্য ত্রিবিধ; পদ্যময়, গদ্যময়, গদ্যপদ্যময়। (সংস্কৃতভাষা
ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব, ঐ, পৃ-- ৭৯)
৪. আখ্যান : ‘অতি
পূর্বকালে, ভারতবর্ষে
দুষ্মন্ত নামে এক সম্রাট ছিলেন। তিনি, একদা, বহুতর।
সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে, মৃগয়ায়
গিয়াছিলেন। (শকুন্তলা,
ঐ, পৃ--
১০৪)।
৫. বিতর্কমূলক গদ্য
: ‘পরাশরবচন, মাধবাচার্যের
মতে, বিধবাদি
বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধয়ক না হইলে, তিনি বিবাহ না করিয়া ব্রহ্মচর্য
করিলে অধিক ফল, পরবচনের
এরূপ আভাস দিতেন না;
কারণ, পূর্ববচন
দ্বারা বিধবাদি বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহবিধি প্রতিপন্ন না লইলে, বিবাহ না
করিয়া ব্রহ্মচর্য করিলে অধিক ফল, পরবচনের এই আভাষ কি রূপে সঙ্গত হইতে পারে। (বিধবাবিবাহ
দ্বিতীপুস্তক, ঐ, পৃ-৫৮৪)
৬. লঘুগদ্য : ‘বকেশ্বরেরা
আপনি ভিন্ন আর সকলকেই বক্ক অর্থাৎ বোকা মনে করে এবং সকলের কাছেই, ফাজিল
চালাকি করিয়া বেড়ায়। খুড় সেইরূপ চালাকি করিয়া আমার
পুস্তকের জবাব
লিখিয়াছেন। কিন্তু উপযুক্ত ভাইপোর কাছে চালাকি করা সহজ নহে।' (আবার অতি
অল্প হইল, বি.
সা. র, ঐ, পৃ--৮৯৪)।
দৃষ্টান্তগুলিতে বিষয়, প্রসঙ্গ, শব্দ ও
ভঙ্গির বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য একটি জায়গায়, তা হল-- গদ্যের নিজস্ব ছন্দসুষমা। বৈচিত্র্যের
মধ্যে এই সঙ্গতিসাধক ঐক্যটিই বিদ্যাসাগরের সৃজনী ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞান। প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের
গদ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে উচ্ছসিত পন্ডিতজনদের অনেকেই তাঁর গদ্যের শিল্পসৌন্দর্যের
দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুপ্রাস-বহুল কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করেছেন, যা থেকে
সাধারণ পাঠকের ভুল ধারনা হওয়া স্বাভাবিক। তাঁরা ‘সীতার বনবাস’ থেকে যে
অংশটি বার বার উদ্ধৃত করেন,
সেটি হল, ‘এই
সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবনগিরি..ইত্যাদি। এখানে গদ্যের ‘অনতিলক্ষ্য
ছন্দঃস্রোত’কে
গৌণ করে দিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে অনুপ্রাস, যা কখনোই বিদ্যাসাগরের গদ্যশৈলীর
অভিজ্ঞান নয়। বরং সাধারণভাবে তিনি অতিরিক্ত অনুপ্রাস ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন।
অনুপ্রাস এসেছে প্রকৃতির শোভায় মানবমনের উদাস আত্মহারা অবস্থাটি ফুটিয়ে তোলার
তাগিদে। মনে রাখতে হবে সমসাময়িক তারাশঙ্কর
তর্করত্নর কথাগদ্য সমাসাড়ম্বর ও অনুপ্রাস ঝংকারে মুখরিত ছিল, পূর্ববর্তী
অক্ষয়কুমারের গদ্যও অনুপ্রাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিদ্যাসাগর
জানতেন-- এই সৌন্দর্য বিধান ভাষার বিশেষ সাজসজ্জামাত্র, তা অনুষ্ঠান
বিশেষে মানানসই, নিত্যদিনের
ব্যবহারের পক্ষে বেমানান।
*ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত।
No comments:
Post a Comment