জৈন মূর্তির হিন্দু দেবদেবীতে রূপান্তর:
শিলাবতী উপত্যকা
বাঁকুড়া তথা দক্ষিণ বাঁকুড়ার একটি
গুরুত্বপূর্ণ নদী শিলাবতী। শিলাবতী বা শিলাই নদীর উৎস পুরুলিয়া জেলার লহড়ার
নিকটবর্তী বড়গা নামক জায়গা থেকে।বাঁকুড়া জেলায় প্রবেশ করেছে ইঁদপুর থানা
এলাকায়।বাঁকুড়া জেলার ছাপান্ন কিমি গতিপথে শিলাবতী সৃষ্টি করেছে একাধিক নয়নাভিরাম
ঝর্ণাধারা।ইঁদপুর থেকে তালডাংরা হয়ে এই নদী প্রবেশ করেছে সিমলাপাল থানা
এলাকায়।বাঁকুড়া জেলার সীমানা শেষ করে প্রবেশ করেছে গড়বেতায় মেদনীপুর জেলার
সীমানায়।ঘাটালের কিছু পূর্বে বন্দর নামক স্থানে শিলাবতী মিলিত হয়েছে দ্বারকেশ্বরের
সঙ্গে এবং নাম হয়েছে রূপনারায়ন।শিলাবতী,দ্বারকেশ্বর ও দামোদরের মিলিত সংগমে
রূপনারায়নের জন্ম এবং এই মিলিত প্রবাহের দক্ষিণতম সমুদ্রমোহনায় প্রাচীন তাম্রলিপ্ত
বন্দর।শিলাবতী নদীর প্রধান উপনদী জয়পন্ডা মিলিত হয়েছে ইঁদপুরের সীমানা পেরিয়ে
সিমলাপাল থানার ভূতশহর গ্রামের নিকটে।
শিলাবতী নদীকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই এক
উন্নত মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।এর প্রমান পাওয়া যায় নদী তীরবর্তী প্রস্তর স্তর
বিশ্লেষণ ও প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রস্তর আয়ুধগুলি থেকে।তবে এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব
সম্পর্কে কোন লিখিত দলিল না থাকায় আমাদের নির্ভর করতে হয় প্রাপ্ত পুরাতাত্বিক
নির্দশনগুলির উপর।মানববসতির অনুষঙ্গ ধরেই এই অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল জৈন
ধর্মের।এর প্রমান বহন করে
চলেছে প্রাপ্ত জৈন পুরাতাত্বিক নির্দশন,গ্রাম নাম,স্থান
নাম,জলাশয় এবং গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মিশে থাকা আচার আচরণ থেকে।জৈন ধর্মগ্রন্থ
আচারঙ্গ সূত্র (1.8.3)অনুযায়ী "Mahavira used this route for his journey and
this region was called Ladha(i.e.Radha)comprising vajiabhumi (vajrabhumi)and
subbhabhumi(sunmabhumi) [Jacobi 1884:84f]". ওই ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায়
মহাবীর রাঢ় দেশে দ্বাদশ বর্ষ অতিবাহিত করে ধর্মমত প্রচার করেছিলেন।ড.রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর
বলেছেন "বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যরা ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে নির্বাচন করেছিলেন
বিহার ও কোশলকে,আর মহাবীর ও তাঁর শিষ্যরা নির্বাচন করেছিলেন রাঢ়ভূমিকে। ''দক্ষিণ
রাঢ়ের অংশ ছিল বাঁকুড়ার অর্ন্তভূক্ত শিলাবতী নদী তীরবর্তী এই অঞ্চল।আচারঙ্গ
সূত্রের সমসাময়িক জৈন ভগবতীসূত্রে (ভাষ্য প্রজাপতি উপাঙ্গ)বলা হয়েছে
জৈনধর্মগ্রন্থগুলিতে যে কটি মহাজনপদের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে রাঢ় অঞ্চল
শ্রেষ্ঠতম। এ থেকে বলা যেতে পারে এই অঞ্চল একদা জৈন ধর্ম প্রচার ও প্রসারের উর্বর
ক্ষেত্র ছিল।আচারঙ্গ সূত্র থেকে জানা যায় হাজারিবাগ জেলার পরেশনাথ পাহাড়ে একটি
জৈনধর্মকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।এই পাহাড়কে জৈনরা বলে 'সমেত শিখর'। এখানে নির্বাণ লাভ
করেছিলেন 20 জন জৈন তীর্থঙ্কর। এই অঞ্চলে জৈন ধর্মের অভ্যুদয় সম্পর্কে ড. প্রবোধচন্দ্র
বাগচী বলেছেন "Parsha the immediate predecesser of Mahavira in the lineage
of Tirthankara is associated with Champa,and in fact the most important jaina
locality connected with the memory of parsha the Paroshnath hill,is in eastern
India."এই পরেশনাথ পাহাড়কে কেন্দ্র করে জৈনধর্ম প্রচারক দল রাঢ় অঞ্চলের
বিভিন্ন এলাকায় জৈনধর্ম প্রচার এবং বহুল পরিমানে জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি ও মন্দির
প্রতিষ্ঠা করেন। এদের প্রভাবেই খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকের পর এই অঞ্চলে জৈনধর্মমত
প্রচারিত হয়েছিল।তবে এই অঞ্চলে জৈনধর্মমতের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটেছিল ১১৩৫
খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ।এর কারণ তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি।১১৩৫ খ্রীষ্টাব্দে
পালবংশীয় রাজা কুমার পালের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কলিঙ্গের গঙ্গ বংশীয় রাজা
অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গ বর্তমান বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমাকে
সম্প্রসারিত করেন। তাঁর এই যাত্রাপথ ছিল সম্পূর্ণ জলপথে। কারণ তৎকালীন সময়ে নদীপথই
ছিল যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মতের সমর্থনে
লিখেছেন "জঙ্গলাছন্ন রাঢ় অঞ্চলে নদীপথই ছিল লোকচলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ
মাধ্যম।তাই দ্বারকেশ্বর,কংসাবতী ও শিলাবতীর গতিপথ ধরেই কিছু দূরে দূরে বর্ধিষ্ণু
প্রাচীন ধর্মকেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল।" অনন্ত বর্মন চোড়গঙ্গ নিজে জৈন
ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং সেই কারণে তাঁর আর্থিক সহায়তায় এই অঞ্চলের সর্বত্র জৈনমঠ ও
মন্দির স্থাপিত হয় এবং জৈনধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। শ্রী এ. কে. বন্দ্যোপাধ্যায়
লিখেছেন "And this should not cause any surprise as up to the 12 th century
A.D the most widely practised religion of the North Indian tradition in Bankura
region was neither Brahminism nor Buddhism butJainism."
রাজনৈতিক কারণের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল
অর্থনৈতিক কারণও। সেকালে শিলাবতী নদীপথ ছিল উৎকৃষ্ট বাণিজ্যপথ।তৎকালীন সময়ে এই
অঞ্চলের দুটি বিখ্যাত তামারখনি ছিল তামাজুড়ি ও তামাখুন। এইসব খনি থেকে জৈন
ব্যবসায়ীরা সড়কপথ ধরে তামা নিয়ে এসে নৌকা বোঝাই করতেন তেলকূপী বন্দরে।এখান থেকে
শিলাবতী,দারকেশ্বর ও কংসাবতী জলপথ বেয়ে ঐ বনিকরা পৌঁছাতেন তাম্রলিপ্ত বন্দরে।এই
জৈন ধর্মাবলম্বী ধাতব ব্যবসায়ীদের দ্বারাই খ্রীষ্টীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে এই
অঞ্চলে জৈনধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। এই বনিকরা তাদের যাতায়াতের পথে গড়ে
তুলেছিলেন বিভিন্ন বিশ্রাম স্থান। এই বিশ্রামস্থানগুলিতে তারা নিজেদের প্রয়োজনেই
গড়ে তুলেছিলেন দেউল,চৈত, উপাসনাস্থল,বিভিন্ন তীর্থঙ্করমূর্তি ও তাদের শাসন যক্ষিণী
মূর্তি।এইরূপ অনেক উৎকৃষ্ট বিশ্রামস্থল গড়ে উঠেছিল শিলাবতী নদী তীরের বিভিন্ন
জায়গায়।হাড়মাসড়া,সিমলাপালের বিভিন্ন জায়গায় প্রাপ্ত ধাতুমলমিশ্রিত ইঁট, লোহা গলানোর
চুল্লি এই তথ্যগুলির সপক্ষে প্রমান দেয়।
সামাজিক কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে
তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলে বসবাস করতো অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা।তারা ছিল ব্রাহ্মণ্য
শ্রেণী দ্বারা শোষিত।তাই জৈন ধর্মের উদারতার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে,জৈনধর্ম গ্রহণ
করেছিল এই সমস্ত অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা। জৈন ধর্ম প্রসারের প্রমান হিসাবে এই
অঞ্চল থেকে উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি,তাদের শাসন যক্ষিণী,জৈন
দেউল,চৌমুখা প্রমুখ।জৈন ধর্ম অপসারিত হবার পর এই সমস্ত জৈন পুরাতাত্বিক নিদর্শন
গুলি গৃহীত হয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বী দের দ্বারা তাদের দেবদেবী হিসাবে। তবে এ কথা
ভুললে চলবে না, জৈন ধর্মের ইতিহাস যেহেতু দীর্ঘ তাই তার ক্ষয় ক্ষতি বিবাদের ঘটনাও
প্রচুর। এই বিবাদ একাধারে যেমন ছিল নিজেদের ধর্মের সাথে,তেমনি অন্য ধর্মের সাথেও। এল
ভাল্লিয়াপ্পা তাঁর নদী কথা বইয়ে এই রকম একটি লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। শৈব ও
জৈনরা শ্রেষ্ঠত্ব পাবার জন্য তামিলনাড়ুর বৈগাই নদীকে বেছে নিয়েছিল। প্রতিদল স্ব
স্ব ধর্মের বিশিষ্ঠ নীতি ও সূত্র গুলি তালপাতায় লিখে জলে ফেলে দিত।মনে করা হতো যে
ধর্মটি শ্রেষ্ঠ তার নীতি লেখা তালপাতাটি স্রোতের উল্টো মুখে নদীর উজান বেয়ে চলে
যাবে।এই লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে জৈন ধর্মের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছিল অনেক বিভাগ ও
উপবিভাগ।শেষ পর্যন্ত দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর এই দুই বিভাগ প্রাধান্য লাভ করে।রাঢ় তথা
দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়ের অর্ন্তভুক্ত শিলাবতী নদী বিধৌত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাপ্ত নগ্ন
জৈন মূর্তি প্রমান করে এই অঞ্চলে দিগম্বর জৈন ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল।প্রথম দিকে
জৈনরা কোন মূর্তি পূজা করতো না।কারণ তারা বিশ্বাস করতো দেবতা নয়, মানুষই তাদের
প্রধান উপাস্য। পরবর্তীকালে চব্বিশজন তীর্থংকরের মূর্তি পূজা তাঁরা শুরু করেছিলেন।
ক্রমশ এই ধর্মের প্রভাব জনমানসে যত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে ততবেশি মূর্তি পূজার
দিকে ঝুঁকেছে জৈন ধর্ম। চব্বিশজন তীর্থংকরের পাশাপাশি তার তৈরী করেছে তাদের
যক্ষ-যক্ষিণী ও নিজস্ব দেবতা মন্ডলী। প্রথম দিকের জৈন মূর্তি গুলির সঙ্গে পরবর্তী
কালের জৈন মূর্তি গুলির পার্থক্য লক্ষণীয়।প্রাচীন মূর্তি গুলিতে
যক্ষ-যক্ষিণী,শাসনদেবি,লাঞ্ছনচিহ্ণ, বৃক্ষ প্রভৃতি ছিল না।ঐতিহাসিক রাখালদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন," অতি প্রাচীনকালের জৈন মূর্তি একখানি পাথরের পট্ট,
ইহার উপরে কতকগুলি চিহ্ণ আঁকা থাকতো। এর নাম আর্যপট্ট বা আয়োগপট্ট।পরবর্তীকালে
জৈনরা তীর্থংকর ও মূর্তিপূজা শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের অনুমান কুশান আমলে
সর্বপ্রথম চব্বিশজন তীর্থংকরের মূর্তিনির্মাণের প্রথাগত শৈলী গড়ে
উঠেছিল । জৈন ধর্মের অবলুপ্তির পর ওই মূর্তি গুলি হিন্দু ধর্ম দ্বারা
গৃহীত হয় এবং তাদের দেবদেবীর রূপ পায়। এইরূপ কয়েকটি দেবদেবী নিয়ে এখানে আলোচনা করা
হল।
দেবী
অম্বিকাঃ- অম্বিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে জৈন প্রতিষ্ঠা সার সংগ্রহ গ্রন্থে বলা
হয়েছে "দ্বি -ভূজা সিংহমারূঢ়া আম্রাদেবী হরিৎ প্রিয়া। "অম্বিকা দ্বাবিংশতিতম
জৈন তীর্থংকর নেমিনাথের শাসন যক্ষিণী।দেবীর দেহ ভঙ্গিমায় স্নেহময়ী জননী রূপের
প্রকাশ।দুপাশে দুই পুত্র-শুভংকর ও প্রিয়ংকরের হাত ও মাথা স্পর্শ করে আছেন ত্রিভঙ্গ
মূর্তিতে।পদতলে সিংহ। শীর্ষদেশে ধ্যানস্থ তীর্থংকর মূর্তি পদ্মাসনে আসীন।মাথার ওপর
বৃত্তাকারে সফল আম্রশাখার আড়ালে দুদিকে দুই বিদ্যাধরী মূর্তি উড়ন্ত অবস্থায়
আছে।দেবী সালঙ্কারা, গলায় রত্নহার,বাহুতে ,মণিবন্ধে,কোমরে অলংকার,কানে কর্ণপাশা। দক্ষিণাধাঁচে
বস্ত্রাবৃতা। কোমরের শাড়ি মেখলার মতো।দেবীর সবচেয়ে লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য, তাঁর স্তন
যুগল, বিল্ব আকৃতি।বামক্রোড়ে অম্বিকার কনিষ্ঠ পুত্র প্রিয়ঙ্কর, ডানহাতে ধরে আছেন
আম্রলুম্বী। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যৈষ্ঠপুত্র শুভঙ্কর। এছাড়াও যক্ষ গোমেধ সহ
অম্বিকার কিছু মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।মূর্তি দুটির কোলে রয়েছে শিশপুত্র।কোন কোন
গবেষক এই মূর্তিটিকে জৈন হর-গৌরী মূর্তি বলে উল্লেখ করেছেন।তবে জৈনরা হর- গৌরী
পুজো করতো কিনা, তা গবেষণা সাপেক্ষ।প্রসঙ্গত বাঁকুড়া জেলায় প্রাপ্ত জৈন তীর্থংকর
মূর্তিগুলির বহুলাংশে নেমিনাথের এবং তাঁর শাসন যক্ষিণী দেবী অম্বিকার।এই অঞ্চলে
নেমিনাথ ও অম্বিকার জনপ্রিয়তার কারণ গবেষণা সাপেক্ষ। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ এবং
প্রাপ্ত জৈন দিগম্বর মূর্তি থেকে জানা যায় মহাবীর ও তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থংকর
পাশ্বর্নাথের পাদস্পর্শ ঘটেছিল এই অঞ্চলে।এই অঞ্চলে মহাবীর ও পাশ্বর্নাথের মূর্তির
আধিক্য এই তথ্যকে প্রমাণ করে।অম্বিকার জনপ্রিয়তার কারণ হিসাবে মনে করা যেতে পারে
হিন্দু দেবী দুর্গার অপর নাম অম্বিকা।এছাড়াও হিন্দুদের শিশুরক্ষাকারী দেবী ষষ্ঠীর
সাথে হাতে শিশু ধরে রাখা এবং সর্বশরীরে মাতৃত্বের চিহ্ণ বহনকারী দেবী
অম্বিকার প্রচুর মিল আছে। তাই তাকে সহজেই নিজেদের দেবী বলে গ্রহণ করেছিল রাঢ়বঙ্গের
তৎকালীন মূল অধিবাসী সমাজের নিচু শ্রেণীর লোকেরা।যারা সর্বপ্রথম জৈনধর্ম গ্রহণ
করেছিল সমাজের উচ্চবর্গীয়দের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে।অন্যদিকে এই রাঢ় বঙ্গের অন্যতম
প্রধান দেবী মনসার যে মূর্তি তৈরী হয় বা তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় অস্তিক ও
কস্তিক বলে তাঁর দুই শিশু পুত্র বর্তমান।যা দেবী অম্বিকার সাথে মিল বহন করে।যদিও
অনেক গবেষকের মতে পাশ্বর্নাথের যক্ষিণী পদ্মাবতীর সাথে দেবী মনসার যথেষ্ট মিল
পাওয়া যায়।তাই দক্ষিণ বাঁকুড়ার অম্বিকানগর,কেচন্দা,সিমলাপাল,গোতড়া, কলামী প্রভৃতি
জায়গায় দেবী আম্বিকার মূর্তির এত ছড়াছড়ি।মনে রাখতে হবে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা
ছিল সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা এবং তারাই সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয়েছিল জৈনদের
দ্বারা। তাদেরই উপাস্য দেবী ষষ্ঠী ও মনসা ।ফলে এই অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের কাছে
টানার জন্যই জৈন ধর্মের লোকেরা তাদের দেবদেবী ও সংস্কৃতিকে কাছে টেনে নিয়েছিল।তাই
জৈনদের অম্বিকা মূর্তিতে অনার্য কৃষ্টির ছাপ অধিক।অম্বিকার চিহ্ণ গুলি
লক্ষণীয়-দেবী সফলা আম্রবৃক্ষের নীচে অধিষ্ঠান করেছেন ,অর্থাৎ শষ্য ফল প্রদানকারী।
দুই সন্তানের জননী এবং সিংবাহিনী যা দেবী দুর্গাকে নির্দেশ করে।প্রসঙ্গত শিলাবতী
নদী তীরবর্তী যে সব গ্রাম গুলিতে দেবী অম্বিকার মূর্তি রয়েছে সেই গ্রাম গুলিতে
কোথাও পৃথক ভাবে দেবী দুর্গার পুজো করা হয় না। বলা যেতে পারে প্রাপ্ত জৈন অম্বিকা
মূর্তি হিন্দুরা দুর্গা হিসাবে গ্রহণ করে আরাধনা শুরু করে।
বাণেশ্বরঃ- আঁকড় গ্রামে বাণেশ্বর
শিব হিসাবে যে লিঙ্গটি পূজিত হয় সেটি প্রকৃতপক্ষে একটি জৈন চৌমুখা।গবেষকদের মতে
জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা পূণ্য অর্জনের জন্য জৈন তীর্থক্ষেত্রে এগুলি অর্পণ
করতেন।জৈন চৌমুখাটির দুপাশে দুটি জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি আছে।প্রায় নষ্ট হতে বসায়
বোঝা দুঃসাধ্য এগুলি কোন তীর্থঙ্করের।তবে একটি সম্ভবত পার্শ্বনাথের।প্রসঙ্গত পাল
রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উড়িষ্যার গঙ্গ
বংশীয় রাজা অনন্তবর্মণ তার রাজ্যের
সীমানা আরম্যবাগ বা আরামবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন।তিনি নিজে ছিলেন
জৈনধর্মাবলম্বী। তার পৃষ্ঠপোষকতাতেই দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে জৈন
ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে।তবে বাংলায় সেন রাজাদের রাজত্ব শুরু হলে
পরিবর্তন ঘটে রাজনৈতিক পটভূমিকার।তাঁরা ছিলেন শৈব।স্বভাবতই শৈব ধর্ম প্রসারে ব্রতী
হয়েছিলেন তারা।সেই সময় বহু জৈন উপাসনার স্থান রাতারাতি শৈব উপাসনা স্থানে পরিণত
হয়েছিল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভের আশায়।আঁকড় গ্রামের জৈন চৌমুখা শিব হিসাবে পূজা
পাবার এটি একটি কারণ বলে মনে করা যেতে পারে।
এই শিব লিঙ্গটি সারাবছর
জলের তলাতেই থাকে।চৈত্রমাসে গাজন উপলক্ষ্যে জল সিঞ্চন করে লিঙ্গটি বার করা হয়। এটি
গভীর গর্তের মধ্যে অবস্থিত।জনশ্রুতি পূর্বে পার্শ্ববর্তী ঠান্ডা পাড়ায় অবস্থিত ছিল
লিঙ্গটি।মাঝি ধর্মাবলম্বী ঐ গ্রামের অধিবাসীদের মূল জীবিকা চিঁড়া কুটা(ঠেকির
সাহায্যে ধান থেকে চিঁড়া তৈরী করা)।চিঁড়া কুটার শব্দে বিরক্ত হয়ে শিব শিলাবতীর
স্রোত ধরে আঁকড় গ্রামের এই স্থানে এসে অবস্থান করেন এবং পুরোহিত কে স্বপ্ন
দেন।পুরোহিত অব্রাহ্মণ,লোহার সম্প্রদায়ের।বর্তমান পুরোহিতের নাম মিহির লোহার।চৈত্র
সংক্রান্তিতে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। একদিনের মেলা বসে।তবে গাজনে ভক্তা হওয়া এবং ঢাক
বাজানো সম্পূর্ণ রূপে নিষেধ।
শান্তিনাথঃ গাঁড়রার শিব থানটি বেশ
প্রাচীন এবং শিব লিঙ্গটি বৃহৎ।শিবের নাম শান্তিনাথ।প্রসঙ্গত ষোলতম জৈন তীর্থঙ্করের
নাম শান্তিনাথ।শিবের বাহন ষাঁড়। অনুরূপে প্রথম জৈনতীর্থঙ্কর ঋষভনাথের
লাঞ্ছনচিহ্ণ ষাঁড়।শিবথানে কোথাও বলির প্রচলন নেই।জৈনরাও অহিংসার পূজারী।এই
শিবথানের পুরোহিত ব্রাহ্মণ হলেও এর মূল উপাসক এলাকার অন্ত্যজ শ্রেণী।
দেউলভিড়া গ্রামের খাঁদাসিনি: দেউলভিড়্যা গ্রামে রায়
পরিবার কতৃক পূজিত খাঁদাসিনির যে থান আছে,সেখানে মাটির হাতিঘোড়ার মধ্যে
পূজিত হয় কালো রঙের ক্লোরাইট পাথর নির্মিত একটি মূর্তি।পুরুষ মূর্তিটির
একহাতে তলোয়ার, অন্যহাত বুকের উপর স্থাপিত ।মূর্তিটি সম্ভবত কাল ভৈরবের।শৈব
সংস্কৃতির অংশ ।এই মূর্তিটি আকারে নিকটবর্তী পার্শ্বনাথ মন্দিরে অবস্থিত কুলুঙ্গির
অনুরূপ ।প্রসঙ্গত জৈন ধর্ম দূর্বল হয়ে পড়লে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জৈন থান শৈবথানে
রূপান্তরিত হয়। এর মূল কারণ উড়িষ্যা থেকে আগত পশুপত শৈব ধর্মের প্রাবল্য
।যাদের প্রভাবেই এই অঞ্চলের বেশিরভাগ শৈব থান গুলি গড়ে উঠেছিল ।পাশাপাশি সেন
রাজত্বের উথ্থান।যারা ধর্মের দিক থেকে ছিলেন শৈব।সুতরাং বলা অত্যুক্তি হবে না শৈব
ধর্মের প্রাবল্যের কারণেই পূর্বের পার্শ্বনাথ মন্দির শৈব ধর্মের পীঠস্থান এ
পরিণত হয়।যার প্রমাণ ঐ মহাকাল মূর্তিটি ।
তেইশতম জৈন তীর্থঙ্কর
পার্শ্বনাথ।লাঞ্ছন চিহ্ণ সাপ।পার্শ্বনাথের মূর্তি পাওয়া গেছে সিমলাপাল ব্লকের
লায়েকপাড়া গ্রামে।এখানে এটি খাঁদারানি নামে পূজিত হন।তালডাংরা থানার হাড়মাসড়ায় যে
পার্শ্বনাথ মূর্তিটি রয়েছে সেটি পূজিত হয় খাঁদাসিনি নামে। প্রসঙ্গত খাঁদারানী বা
খাঁদাসিনির পুজো জৈনদের প্রকৃতি পুজোর নামান্তর।
ভৈরবঃ লক্ষীসাগরের রঙ্কিণী তড়ায় রয়েছে
একটি বৃহৎ মহাবীরের মূর্তি।এটি ভৈরব হিসাবে পূজা হয়। অন্য আর একটি মহাবীর মূর্তি
থয়েছে হাড়মাসড়ার পাঁচঘরিয়া পাড়ার শিবমন্দিরে।অলকধারা গ্রামের মহাবীর মূর্তিটি
বর্তমানে পূজিত হয় ভৈরব হিসাবে।হিন্দু ধর্মে শিবের অন্যতম দ্বাররক্ষী ভৈরব।অন্ত্যজ
শ্রেণির লোকেরা কৃষি দেবতা হিসাবে ভৈরবের পূজা করে। বর্তমান মূর্তির পুরোহিত
গাঁড়্ররা গ্রাম নিবাসী সৎপথী পদবী ধারী ব্রাহ্মনেরা।
মণিভদ্রঃ- -হিন্দুদেব গণেশ
মণিভদ্র হিসাবে পূজিত হন জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে।তবে মূর্তির গঠনগত একটু পার্থক্য
রয়েছে।মণিভদ্রের একটি মূর্তি উদ্ধার হয়েছে গাঁড়রার শান্তিনাথ শিব মন্দির সংলগ্ন
একটি পুকুর থেকে।মূর্তিটি পুকুর থেকে তোলার সময় মূর্তিটির বেশ কিছু অংশ ভেঙ্গে
যায়।সেটি সিমেন্ট দিয়ে সংস্কার করায় মূর্তিটির প্রকৃত রূপ নষ্ট হয়ে গেছে।বর্তমানে
এটি হিন্দুদেব গণেশ হিসাবে পূজিত হয়।
উপরের আলোচিত মূর্তিগুলি ছাড়াও এইরূপ
অজস্র মুর্তি রয়েছে শিলাবতী নদীর দুইতীরে যেগুলি জৈন ধর্মের হলেও গৃহীত হয়েছে
হিন্দু দেব হিসাবে। নিবিড় ক্ষেত্র সমীক্ষা বিষয়ে আরও তথ্য তুলে আনবে বলে আশা করি।
তথ্যসূত্র
১. "Ambika in Jaina Art and
Literature"-Dr. M.N.P. Tiwari, Bharatiya Jainpith 1989
২. "বাঁকুড়া জেলার
পুরাকৃতি"- অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫০
৩. "History of
Bengal,vol-1,Edited by R.C Majumdar
৫. "District Hand Book
Bankura" A. Mitra
৬. বাংলার ইতিহাস (১ ম খন্ড) -রাখালদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়
৭. বাঁকুড়া -তরুণদেব ভট্টাচার্য
ব্যাক্তিঋণ
১. রিংকু মহান্তী, সিমলাপাল
২. তিমিরকান্তি পতি, হাড়মাসড়া
৩ সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
৪ দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়, হিঁড়বাধ
৫ শুভেন্দু তন্তুবায়, ইঁন্দপুর
চিত্র
১) কালভৈরব, দেউলভিড়্যা
২) অম্বিকা, অম্বিকানগর
৩) ঋষভনাথ, লক্ষীসাগর
No comments:
Post a Comment