তৃতীয় পর্ব
[আগে যা ঘটেছে – ঝন্টু দাস পলিসি বেচে খায়। বিয়ে হয় নি, একলা মানুষ। হঠাৎ
দেখা গেল নানান বিলেতের বিখ্যাত ভূতেরা তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী। তারা তাকে
নিজেদের মনের কথা জানাতে ব্যাকুল। লেনিন থেকে মার্ক্স, ম্যালথাস থেকে এডমান্ড
বার্ক, এমন কি আন্তোনিও গ্রামসচ্চি তার সাথে গল্প করতে আগ্রহী। ভূতেদের মধ্যে
নানান বিতর্ক, মারামারি। বাকুনিন চাইছে মার্ক্সকে এক হাত দেখে নিতে। সব মিলিয়ে
ঝন্টু দাসের জীবন হটাত করে রঙিন হয়ে উঠেছে। বার্ক সাহেবের বাড়িতে ওয়াইন এবং আড্ডার
পর আলাপ হল মার্ক্সের মেয়ে এলানরের সাথে। তারপর…]
আমি আর এলা আজকাল মাঝে মাঝেই লেকে বসে
আড্ডা মারি। এলা মানে এলানর। মার্ক্স সাহেবের মেয়ে। মনে নেই? সেই যে আমার সাথে দেখা
হল, আমার কাছ থেকে সিল্ক কাট নিয়ে খেলো, মনে পড়ছে? এর আগের কিস্তিটা ওখানেই শেষ করেছিলাম।
মনে পড়লো? হ্যাঁ, সেই এলানর। ঠিক ধরেছেন, যে বলেছিল যে সে সুইসাইড করেছিল। অনেক দিন
বাদে আবার একটু প্রেম প্রেম ভাব জেগেছে আমার মধ্যে। আপনি হয়তো বলবেন, “ভূতের সাথে প্রেম?” আরে বাবা, ভারতীয়
সংবিধানে কোথায় বলেছে যে ভূতের সাথে প্রেম করা বেআইনি? জ্যান্ত প্রেমিকা জূটলো না তো
ভূতই চলেগা। আর যে সে ভূত নাকি? রীতিমত মেমসাহেব, তায় আবার মার্ক্স সাহেবের মেয়ে। নো পেঁয়াজি।
এলা ভারি ভালো মেয়ে। মাস গেলে আমার
রোজগার কত এটা সে একবারও জিজ্ঞেস করেনি। আর যেহেতু সে আর মানুষ নয়, সেহেতু এই গরমের
দেশে মেমসাহেবের
কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। দামী রেস্তোরায় নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোরও কোনো প্রয়োজন নেই।
ব্যাপারটা বেশ সুবিধেজনক, বুঝতেই পারছেন।
খালি একটাই সমস্যা। এলার মগজটা সাঙ্ঘাতিক ধারালো। তার
সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার পক্ষে বেশ মুস্কিল আর কি। বুঝতেই পারছেন, নেহাতই বেচে
খাই, এই সব ইন্টেলেকচুয়াল মেয়েদের সাথে লাইন মারাটা খুব সোজা ব্যাপার নয়। তারপর
আবার এলানরের স্বামী তাকে ধোকা দিয়েছিলো, তাই সে আত্মহত্যা করেছিলো। কাজেই আমার
ব্যাপারে সে একটু বেশি পসেসিভ আর কি। প্রতিদিনই তার সাথে অনেকটা সময় না কাটালে তার
মন খারাপ হয়ে যায়। সেদিন আমি একটু টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিলাম, কোহলি দারুণ
ক্যালাচ্ছিল, হঠাৎ এলার আবির্ভাব এবং সে আমাকে বলল যে তার খুব ডিপ্রেশন হচ্ছে। আমি
বললাম, কেন? কি হল? আমার চোখ তখনও টিভির দিকে।
“কিছু লোক কি পরিমাণ টাকা কামাচ্ছে
এই খেলা দেখিয়ে সেটা ভেবেছো? আর তুমি বোকার মত বসে বসে দেখছো। তোমাকে এন্টারটেন্মেন্ট
বেচে দিয়ে ওরা কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি গরিবই থেকে যাচ্ছো। শুধু তুমি নও, তোমার
মত আরো কয়েক কোটি লোক এই ভাবে বোকা হচ্ছে। ধনতন্ত্র তোমাদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে কিন্তু
তোমরা কিছুই বুঝতে পারছো না।“
আমার মনটা কিঞ্চিত খারাপ হয়ে গেলো।
কথাটা বোঝার মত বুদ্ধি যে আমার নেই তা নয়, কিন্তু আমারও একটু মৌজ-মস্তি দরকার নাকি?
সারাক্ষণ গম্ভির গম্ভির চিন্তা-ভাবনা করলে চলবে কি করে? কালকেই আবার তিনটে ক্লায়েন্টের
পিছনে ছুটতে হবে। আজ একটু বিয়ার সহযোগে কোহলির ক্যালানি দেখলে মন্দ কি বলুন তো?
আমি বললাম, “তা কি করবো যদি টিভিতে
খেলা না দেখি?”
এলানর বলল, “কেন তুমি শেক্সপিয়র পড়তে
পারো। আমার তো মুখস্ত।“
আমি তো বিছানা থেকে প্রায় পড়ে যাই আর
কি। আমি পড়বো শেক্সপিয়র? পাগল না প্যান্টালুন? আমি হেসে বললাম, “আরে এলা, আমার মাথায়
তোমার মত বুদ্ধি নেই, আমি পাতি পাবলিক।“
-
“বুঝলাম না। এর সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক আছে? আর দুজন হোমো সেপিয়নের
মধ্যে বুদ্ধির তফাত খুব একটা হয় না। আমাদের বাড়িতে তো সারাক্ষণ শেক্সপিয়র নিয়ে আলোচনা
হয়। আমরা তো ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন এই নিয়ে আড্ডা মারছি নানান মজার মজার সিন নিয়ে।
বাবার তো সব কটা নাটক মুখস্ত।“
আমি তো হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম
না। আমি বললাম, “আরে ম্যাডাম, তোমার বাবার মাথা আর আমার মাথা কি এক হল?” আমার তো আজকাল ফেলুদা –
ব্যোমকেশই পড়ে উঠতে পারি না। সারাদিন খাটাখাটনি করে তারপর আর বই-টই পড়া হয় না
বুঝলেন ম্যাডাম।“
এলানরের চোখে দেখলাম জল। ভাবলাম, এই মেরেছে, যার সাথে
লাইন মারার চেষ্টা করছি সে আমার কথায় কেঁদে ফেলছে কেন? বললাম যে কাজের চাপে বই পড়া
হচ্ছে না, তাতে কেঁদে ফেলার কি হল রে বাবা। নারীর মন বোঝা ভার, তা জ্যান্তই হোক আর
ভূতই হোক।
এলাকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, “ডার্লিং, কী হলো, তোমার
চোখে জল কেন?”
এলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জানো, বাবার সবচেয়ে বড়
দুঃখ ঠিক এইটাই। রুজি রোজগারের চাপে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তারা আর কবিতা লিখতে
পারে না, গল্পের বই পড়তে পারে না, ছবি আঁকতে পারে না, নতুন চিন্তা-ভাবনা করতে পারে
না।“
আমি বললাম, এটা অবশ্য ঠিক। ছোটবেলায় কত কি স্বপ্ন
দেখতাম। বেশ ভালো ছবি আঁকতাম জানো এলা। এখন কাজের পড়ে শুধু এইসব টোয়েন্টি টোয়েন্টি
ম্যাচ দেখা ছাড়া আর কিছুই হয় না।
এলা আমাকে বলল, “আমি তোমাকে শেক্সপিয়র বুঝিয়ে দেবো।
দেখবে দারুণ মজার। তাছাড়া তোমাদের দেশেতো অনেকগুলো সিনেমাও হয়েছে শেক্সপিয়র-এর
নাটক থেকে।“
আমি বোললাম, “বাহ, দারুণ হবে। কিন্তু তোমার বাবার উপর
ওই বাকুনিন নামক বিশাল চেহারার লোকটি অত রেগে আছে কেন বল তো?”
এলা বলল, “মজার ব্যাপার। বলবো। আগে একটা সিল্ক কাট
দেখি।“
আমি বললাম, “মাই প্লেজার, ম্যাডাম।“
এটা আগে কখনো ক্ষেয়াল করিনি তো । দারুন ব্যাপার তো। কি অদ - ভূত!!!
ReplyDelete