অংশুমান করের 'আমি বিনয় মজুমদার' উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বিশ্বজিৎ লায়েক





অশ্বিনীতারার কবি বিনয় মজুমদার

('আমি বিনয় মজুমদার' উপন্যাসের বিনয়পাঠ)

ঘরের ভিতর একটা খাট। খাট অর্থে চৌকি। একটা বাক্স। টেবিলের উপর টুকিটাকি। অগোছালো ঘর। মেঝেতে শুয়ে আছেন বিনয়বাংলা কবিতার অনন্য ঈশ্বর। নমঃশুদ্র বাঙালি কবি। বিনয় মজুমদার। যাঁর কবিতার কালো কালো অক্ষরে বিরহ আর মিলনের আত্মবিনাশী চাঁদ। একক প্রেমের হাহাকার। গণিত,প্রেম, নারী আর তাদের ছায়ায় ভিতর হৃদয় বিষ্মিত এক বিমর্ষ অসুখে তিনি চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছেন।

“একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেল – এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম ফল হল।

তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধ কথা।” ( গায়ত্রীকে)

পৃথিবীতে বসে পৃথিবীকে মঙ্গলগ্রহ ভাবার মতো যাঁর কল্পনার ত্বরণ তাঁকেই পথের দেবতা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটিয়ে নিয়ে গেছে বারংবার। অংশুমান কর ‘আমি বিনয় মজুমদার’ উপন্যসে লিখছেন- তাঁর সেই ছোটোবেলায় পড়া ‘পথের পাঁচালীর’র শেষটুকু মনে পড়ে। সত্যিই, পথ তাঁকে কতদূরেই না নিয়ে এল। তিনি জানেন না, পথ তাঁকে আর কোথায় নিয়ে যাবে।’ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে অপুর কথা। বেদনার গাঢ় রসে মন গেঁজিয়ে ওঠে। ভারাক্রান্ত হয়।


শৈশবের সেই পূর্ববঙ্গগোপালগঞ্জের মাঝিগাতি-তারাইলশিমুলপুরেবসবাস কলকাতায় তাঁর কলেজজীবনের দিনগুলি, বেঙ্গল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে, কফিহাউস, হোস্টেল জীবন, কবিতা, গায়ত্রী, প্রেম আর গণিতের আবর্তে জড়িয়ে পড়া, রুশভাষা শিখে রুশগ্রন্থের অনুবাদ, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ, হাঁপিয়ে ওঠা, সন্ধ্যার নক্ষত্রের দিকে চেয়ে থাকার অনন্ত স্বাদে বঞ্চিত কবির সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়া, বিশুদ্ধ চাকুরির খোঁজ, বারবার চাকরি ছেড়ে দেওয়া, অর্থকষ্ট, সামান্য জেল যাত্রা, মানসিক চিকিৎসার জন্য গাদা গুচ্ছের হাসপাতাল পরিভ্রমণ, আবার গ্রামের বাড়ি শিমুলপুরে ফিরে  আসা আর 'বিনয়তারা' হয়ে যাওয়া। জীবনের সমস্ত কিছুকেই দুই মলাটে বেদনার আরক্তিম অক্ষরে সাজিয়ে দিয়েছেন কবি অংশুমান কর তাঁর 'আমি বিনয় মজুমদার' উপন্যাসে

এই উপন্যাসটি কেমন!
আমি জানি না
এই বইটির সঙ্গে টানা দশদিন সময় কাটাতে গিয়ে দেখলাম, অংশুমান কর এই বইটি রচনার ক্ষেত্রে অসামান্য আঙ্গিক প্রয়োগ করেছেন তাতে বিনয়ের কবিতাদর্শন, তাঁর গণিত ভাবনা এবং কবির অন্তঃকরণের নিহিত বেদনাকে এমনভাবে উন্মোচিত করেছেন যে আমার মতো নগণ্য পাঠকও বিনয়ের মনোজগত, গণিত দর্শন ও কবিতার ভুবনটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তাঁর অন্তর্নিহিত বেদনার জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছি

অসুস্থ। অথবা মোটামুটি সুস্থ। ভয়ানক অসুস্থ। মাঝে মাঝে জ্বর। মনখারাপ। এইভাবেই পুরো একটা জীবন কেটে যায়। সেই জীবনের অন্তরঙ্গ বিষাদ আর বেদনাকে গোটা একটা উপন্যাস জুড়ে নির্ভার করে দেখিয়েছেন কবি অংশুমান-‘মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে’। সবেদা গাছটা আড়চোখে চেয়ে থাকে রাতের ভিতর... আর তিনি চেয়ে থাকেন সেই উঁচু বৃক্ষদেবতার দিকে।

“এতদিনে প্রকৃতই আমি ভালো আছি
আমাদের ধরাধামে আমি থাকি এক গ্রামে
পেয়েছ আমার পত্র – এই ভেবে বাঁচি।” ( এতদিনে- শিমুলপুরে লেখা কবিতা)
ত্রিকোণ প্রেমে আশ্রিত তাঁর জীবন। এককোণে কবিতা। অন্য দুই কোণে গণিত ও গায়ত্রী। মাঝখানে ‘দিব্যোন্মাদ' বিনয় লিখছেন ‘গণিতের শূন্য’ –
“কেন ব্যাথা পাও বলো পৃথিবীর বিয়োগে বিয়োগে?”
আর কিছু নয় কেবল কবিতা লিখেই তিনি ভাল থাকতে চেয়েছিলেন। গণিতের কবিতা। অনুভূতির কবিতা। বিশ্বের কবিতা।
কবিতা হয়ত সবার জন্য নয়! গণিত! না, তাও নয়। অথচ কবিতায় যে আনন্দ গণিতেও সেই আনন্দ! সেই অকৃত্রিম রস!
“গণিত ও কবিতা একই জিনিস। অভিধানের সব শব্দই গণিত সমীকরণ হয়েছে। ফলে এই বিশ্বে সব কিছুই গণিত হয়ে গেছে। সব সাহিত্য গণিত হয়ে গেছে।”

সকাল। ঘুম থেকে উঠলেন তিনি। বিনোদিনী কুটির। বারান্দায় বসে – চা আর বিস্কুট।
“... যখন দুজনে
যুবক ও যুবতী ছিলাম।
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে
চিঠি লিখব না।

আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।” ( আমরা দুজনে মিলে – হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ)

সকালের জলখাবার। দুপুরের ভাত। আলু সেদ্ধ। উচ্ছে। ডিম। মাছ। গরম পিঠে দুধ পুলি। বিয়ে করেননি কেন?
“এই হচ্ছি আমি; প্রণয়ীর মতো নিজেরই সঙ্গে নিজে কথা বলি। অথচ অবিকল আলাদা দুজনের মতো হয়ে । এই আমি, নিজেই নিজের স্বামী, এবং নিজেই নিজের স্ত্রী।’’


আজীবন তিনি কবিতার সত্যে ঈশ্বরীর সন্ধানী। ঈশ্বরী তিনি নিজে। কবি নিজেকেই রচনা করেন তাঁর কবিতায়। আশ্চর্য নারীর জন্য যাঁর বিহ্বলতা – শ্বাসরোধী কথা – গণিতের সন্নিবেশ। প্রস্বাব করার মতো অগোচরে যাঁর বেদনা ঝরে যায়।
কলকাতা যাপনের সেইদিনগুলি এক একটা দিন খিদের চোটে ছটফট করতে থাকেন। কফি হাউসে গিয়ে কবি ধূর্জটি চন্দ'র কাছে এক প্লেটের জায়গায় দু প্লেট মাটন আফগানি চেয়ে খেয়ে নেনঅর্থের সংকট যদিও তাঁকে কবিতা থেকে দূরে সরায়নি তবু যে একাকীত্ব আর সঙ্গীন অবস্থার মধ্যে তিনি এক এক সময় সাঁতরাতে সাঁতরাতে জীবনের দূর সীমানায় গিয়েছেন তা অনন্ত বিস্ময়ের! কল্পনাতীত এক মহা জীবনের আখ্যান

এই জীবনী মূলক উপন্যাসে বিনয় কবির জীবন-যাপন যে ভাবে কবি অংশুমান কর বেদনার আর্তিতে লিপিবদ্ধ করেছেন তা অন্য কারো পক্ষে হয়ত সম্ভবই ছিল না এই লেখা লিখতে বিনয়ের অন্তঃকরণে গিয়ে ছুঁয়ে আসতে হয় আতা নামের সেই বেদনা টিকে। 'তার ভেতরে কালো বীজ।/ তবে চারপাশে সাদা শাঁস আছে।/ রস আছে...' পড়তে পড়তে তা অনুভব করিআরো বেশি বেশি বিনয় মুখী করে তোলে
'আমি পাগল নইআমাকে পাগল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।' যিনি নির্ভুল অঙ্ক কষতে পারেনগণিতকে যিনি নিমেষে কবিতা বানিয়ে দিতে পারেন তিনি নিশচয় পাগল নন

“ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।” (২১ মে ১৯৬২)

সেই তিনিই লিখছেন, ‘ মনে যদি শান্তি থাকে তবে আর কোনো কিছু
চাওয়ার থাকে না।’
‘ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে
শান্তি এনে দিতে।’
রীরে আর জোর নেই। জীবনের সমস্ত তিক্ততা মুছে দিয়ে দিয়ে তিনি একটু শান্তি চাইছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘যাবার সময় হল বিহঙ্গের’ কবিতাটির দ্বেষহীন মাধুর্যে তিনি শান্তি খুঁজছেন।

ক্লাস একাদশে পড়ার সময়ই জেনেছিলেম শরীরেরব ইন্টিগেশন করলে মেয়ে নয় ছেলেই জন্মায়। ব্যাপারটা এইরকম -
ʃbody =boʃdy=boy= বালক=কেলো
আর বিনয় মজুমদার তাঁর ‘আমিই গণিতের শূন্য’তে গণিত, ক্যালকুলাস, ,সমীকরণ পেরিয়ে লিখলেন-
“আমি বিনয় মজুমদার। আমার পত্নীর নাম রাধা
আমার পুত্রের নাম কেলো।’’
অর্থাৎ বিনয় হল শরীর। রাধা এই সম্পর্কের ইন্টিগেশন। আর প্রাপ্ত ফল পুত্র কেলো।
"রাধা"নামেএক দেহোপজীবিনী। আর তাদের সন্তান "কেলো"অংশুমান এড়িয়ে যেতে পারেননিবরং এড়িয়ে গেলে অনেকখানিই অবিচার করা হত শুধু বিনয়ের সঙ্গেই না পাঠকের সঙ্গেও



... চাকরি-বাকরি ছেড়ে তাঁর তাবৎ বোধিচর্যা নিয়ে আমাদের জন্য কবিতা প্রণয়নে তাঁর সমগ্র মরজীবন নিয়োজিত করেছিলেন, বাংলা কবিতায় তাঁর জন্য একটি বলয় সুনির্নীত হয়ে গেছে। কীভাবে এই বৃত্তবলয়কে সংরক্ষণ করা যায়, তার ভার আমরা মিডিয়া গ্রস্ত সাহিত্য- ঐতিহাসিকদের হাতে ছেড়ে দেব না। বিনয় নিজেই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, কীভাবে , কোনও অধ্যাপকের সদয় সহায়তা ছাড়াই তাঁর কবিতা আমরা স্বীকরণ করে নিতে পারি।” ( আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত )
অংশুমান কর নামী অধ্যাপক কিন্তু বিনয়ের প্রতি তাঁর অশেষ মুগ্ধতা আমি দেখেছি সেই আঠারো উনিশ বছর আগে থেকেইকবিতা জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় অংশুমানদার হাত ধরেইএবং প্রথম বিনয় পাঠ সেও অংশুমান দার সৌজন্যে
বিনয় জানতেন ‘হৃদয় বিষ্মিত এক বিমর্ষ অসুখে’ তিনি ভারাক্রান্ত তাই তাঁর যাপনে এতো এতো অভিঘাত। নিজেই নিজের মধুরতাকে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিয়েছেন।
“কেউ কেউ আছেন যাঁদের জন্মই যেন আক্রান্ত হওয়ার, বিদীর্ন হওয়ার, আহত হওয়ার জন্য। তাঁরা চিরকাল মাথা নুইয়েই আছেন এবং তাঁদের মাথায় কাঁটার মুকুট। তাঁরা আহত হয়ে বিলাপ করেন না, জগতের সামনে কেবল সবিনয়ে নিজেদের ক্ষত তুলে ধরেন।” ( জ্যোর্তিময় দত্ত )
“বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ণ করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ।”

বিনোদিনী কুঠির সামনের মাঠ। গাছতলায় বসে আছেন বিনয়। গোল হয়ে বসে আছেন আরো আরো তরুণ কবি। গল্পের সঙ্গে মিশে আছে চায়ের লিকার...
“মনে রেখ মনে রেখ বলে কোনো লাভ আছে নাকি?
মুকুরের সম্মুখের থেকে সরে গেলে আর মুকুরের বুকে
চিহ্নই থাকে না কোনো।’’

উপন্যাসটি নির্মাণে বিনয়ের জীবনী, তাঁর সাক্ষাৎকার, কবিতা প্রবন্ধের অংশ, স্মৃতিকথন, বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছেআর তাতেই বিনয়ের মনোজগত, গাণিতিক ভাবনা ও কবিতার ভুবন ত্রৈরাশিক সমীকরণের মতো একটি বীজের সঙ্গে অন্য আরেকটি বীজের যোগাযোগ সম্ভব হয়েছেতাই আমরা বিনয়ের ভুবনে যত ভিতরে গিয়ে বীজের মান খুঁজি বীজ ততই অঙ্কুরোদগম প্রয়াসী হয়

প্রেম ও বিরহবেদনার রক্তিম হতাশা থেকে যৌনতার অনুভূতিমালা নিয়ে লিখছেন সম্ভোগ শৃঙ্গারের কবিতা –
“চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি মেঝের উপর
দাঁড়িয়ে রয়েছে চাঁদ প্রকাশ্য দিনের বেলা স্পষ্ট দেখা যায়
চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকি, ঘাসগুলো ছোট করে ছাঁটা
ঘামের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ।
গুহার লিকনো মুখ থেকে সরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
বাহিরে পেটের দিকে চাঁদ হেসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
এমনি চাঁদকে বলি ‘তেল লাগাবে না আজ’ শুনে চাঁদ বলে
‘মাখাব নিশ্চয়ত, তবে একটু অপেক্ষা করো’ বলে সে অয়েল ক্লথ নিয়ে
পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নীচে, তারপর হেঁটে চলে এলে
নিকটে তাকের দিকে, একটি বোতল থেকে বাম হাতে তেল নিয়ে এলে
এসে তেল মাখা হাতে আমার ভুট্টাটি চেপে ধরে।
যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল।
চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
এক হাতে ঘষে ঘষে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল’’
( চাঁদের গুহার দিকে – বাল্মীকির কবিতা )

আমার মনে হয়েছে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে  জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে বিনয়ের যে কয়েকটি কথোপকথন আছে তা আসলে জীবনানন্দের প্রতি বিনয়ের উদ্দীপনা ও কৌতুহলকে একটি আশ্চর্য খেলার মাধ্যমে মান্যতা দেওয়া কখনও কবিতা নিয়ে। কখনও চাকুরি নিয়ে। গায়ত্রী চক্রবর্তী অথবা  চাকাকে অথবা  বনলতা সেনকে নিয়ে। কিম্বা গণিত আর কবিতার বোঝাপড়া নিয়ে জীবনানন্দের প্রতি বিনয়ের উদ্দীপনার প্রকাশ
"...আমি আসলে বলতে চেয়েছি যে, কবিতা গণিত কিন্তু শুধুই গণিত নয়। গণিতের অতিরিক্ত কিছু। আর এও ঠিক যে, নিছক গণিতের পক্ষে কবিতা হয়ে ওঠা কষ্টকর, কষ্টকর নয়, প্রায় অসম্ভব। কারণ, কবিতার প্রধান বস্তু ইমাজিনেশন আর গণিতের উপপাদ্য হার্ড ফ্যাক্টস যা বাস্তব। কবিতায় ইমাজিনেশনকে যত গভীরে নিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো, কিন্তু গণিতে যতই অবস্ট্রাকশনে যাওয়া হোক না কেন তা হার্ড ফ্যাক্টসকে ছেড়ে যেতে পারে না কখনও। বলা যেতে পারে যে, কবিতা ও গণিত দুটিতেই আছে  আবিষ্কারের আনন্দ। তবে কবিতা লিখলেই মানুষ, গনিত আবিষ্কার করলেই মালিক।”

একক মানুষের অনির্দেশ মাত্রাতলে ‘বেদনার গাঢ় রসে’ ডুবে থাকে গান। অতৃপ্তির বৈভব।
‘হৃদয়ের দ্যুতি, প্রেম, মেঘ-শরীরের/ কামনার বাস্পপুঞ্জ।’ জীবনযাপনের একাকীক্তে কবির যাত্রা ‘চাঁদের গুহার দিকে।’ যৌনতা কি পারে একাকী নাবিকের জলে ডুব দিয়ে তুলে আনতে –
“তৎ সবিতুর্বরেনং ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যোনঃ প্রচোদয়াৎ ...”
ইন্দ্রিয়ের ইচ্ছে যৌনতা ও কাম অথবা প্রেম ও যৌনতা। আদিম ও চিরন্তন আনন্দধারা। নারি-পুরুষের সহজাত সম্পাদ্য।
“মম যোনিমর্হদ্ব্রহ্ম তাস্মিন্‌ গর্ভং দধাম্যহম্‌
সম্ভবঃ সর্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত।”
‘আরো বেশি ঘন ঘন’ কবিতায় বিনয় লিখছেন – যৌনতার ‘তুল্য অন্য কোনো কীর্তি মানুষের নেই বলে স্পষ্ট টের পাই।/ ফলে বুঝি বসা হল মানুষের জীবনের কর্তব্য, হয়তো/ একমাত্র কর্তব্য।’
যে কর্তব্য বোধ চলমানতার। আনন্দ উর্বরতার। নিরন্তর সৃষ্টির সদর্থক অর্থময়তা। এই অর্থময়তার সত্যতা মানুষের এক ও অদ্বিতীয় নিয়ন্ত্রক।

“বিনয়ের কবিতাগুলি সত্য ও অসত্যে ভাগ করা। অথচ সত্য সম্পর্কে কেবল মাত্র বর্ণনা করা ব্যতীত বিনয়ের যেন আর কিছু বলার নাই, বারংবার সেই এক চিরন্তন অসত্য সম্পর্কেই তার বাগ বিন্যাস এবং ওই অসত্য অংশটিই কারণ – অনুপযুক্ততা, শিরপীড়া ও প্রেম। ওই অসত্য অংশটিই কবির ব্যক্তিগত অথবা ব্যক্তিগত জীবনী, ওইটুকু পৃথক পৃথক ভাবে লিখে জানানোর জন্যই কবিতার উৎপাত। তাছাড়া এই দুর্দান্ত বিংশ শতাব্দিতে কবিতা রচনার আর অভিপ্রায় কেন? ওইসব ব্যক্তিগত প্রার্থণা ও প্রত্যাখানে নির্লিপ্ত নাই যত আছে অন্যান্য বস্তু বর্ণনা করার সময় – সেসব বস্তুর মধ্যে অগণ্য সত্য ও বৈজ্ঞানিক বিচার লিপিবদ্ধ করা, মনে হয় বিনয়ের কবিতার একরূপ বিশিষ্ট নিয়ম। আমি এমন ধরণের বৈজ্ঞানিক সত্যকে সরাসরি কবিতার মধ্যে হৃদয়গ্রাহী এবং পরাস্ত ভঙ্গিতে বসিয়ে দেওয়া বাংলা কেন নানা সময়ের প্রকৃত ইংরেজী বা বিদেশী কবিতাতেও পড়ি নাই কিম্বা আমার পাঠ অতি অল্প।“ ( শক্তি চট্টোপাধ্যায় )

জীবনের ঘূর্ণাবর্তে তিনি উপলব্ধি করেছেন জীবনের সত্য। বিশ্বের নিয়মের সত্য। দর্শনের সত্য। ফলত সমূহ সত্যের অনুভূতি তাঁর বোধের গাণিতিক সুষমায় কবিতা যাপনে উপলব্ধ।
নাহলে তিনি কি করে লিখলেন –
‘আলোক সম্পাত হেতু বিদ্যুৎ সঞ্চার হয়, বিশেষ ধাতু হয়ে থাকে।’এতো আইনস্টাইনের ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট। যা বাংলা কবিতায় এসে আলো ছড়িয়ে দিয়ে গেল। বিনয় আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির তত্ত্ব বইটির অনুবাদও করেছিলেন। বিজ্ঞান, কবিতা আর গণিত ত্রিকোণ স্পর্শে তিনি যতটা জ্যান্ত সকল লোকের মাঝে বসে তাঁর নিজের মুদ্রাদোষে ঠিক ততটাই ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে উজ্জ্বল দৃশ্যগুলি। মহাবিশ্বের চরম এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাঠক উপলব্ধি করছেন জীবন দর্শনের রাশিমালা। কবিতার অমৃতরস। যেসব কবিতার অন্তর্লীন প্রবাহে ফুটে আছে অফুরন্ত প্রাণের আলো অংশুমান সেই আলো খুঁড়ে খুঁড়ে দেখাচ্ছেন ভিতরের তুমুল অন্ধকার, দগদগে ঘা।

‘ফিরে এসো,ফিরে এসো চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।’ ( ফিরে এসো চাকা )
চাকা অর্থে গতি। চৈতন্যের গতি। স্থবির চেতনায় দীর্ঘতম ঘাত। আত্মযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসা হোমাগ্নি যার দহনে আমাদের নব নব জন্মান্তর। কবিতার মহাকাব্যে নতুন অক্ষাংশের সূচনা। যেখানে কবিতার স্বরলিপি জীবনের অন্তহীন ধারাপাত।

বইটির নাম ‘ফিরে এসো চাকা’ হল কীভাবে! এই উপন্যাসে একটি সুন্দর বর্ণনা আছে। কীভাবে গায়ত্রী চক্রবর্তীর চক্রবর্তী 'চাকা' হয়ে গেলবিনয়ের বন্ধু সরোজ চক্রবর্তীর কাছে দেখা করতে গেলে বিনয় দেখেন নেমপ্লেটে লেখা ‘সরোজ চাক’। ‘চাক’-এর স্ত্রী লিঙ্গ ‘চাকা’ করে বিনয় বইয়ের নাম দেন ‘ফিরে এসো চাকা’।
‘আমি বেশ সুখে আছি আনন্দও আছে
আমার ভিতরে, এই আনন্দ মুখস্থ করা যায়;
অন্যের অন্তরে গিয়ে আমার আনন্দ স্থিতি পায়
আমার নূতনত্বটি শব্দে, বাক্যে, স্বরে।’ ( কবিতা বুঝিনি আমি )

এত যত্ন নিয়ে অংশুমান গায়ত্রীর উল্লেখ করেছেন যে বিনয়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা এবং পরবর্তী কালে বিনয়ের কবিতায় গায়ত্রীর প্রেমসমারোহ এবং তারওপরে শেষ উল্লেখে আমাদেরকে একটি রহস্যময় স্তব্ধতার দিকে নিয়ে যায়
"- আপনি তো রসিক লোক মশাইকিন্তু এইবার তো আমার কৌতুহল হচ্ছে গায়ত্রী সম্বন্ধেগায়ত্রী সত্যিই কে?
- এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব নাকেন-নাআপনিও আমাকে বলেননি বনলতা সেন কে।"

রূপের যেমন অরূপ আছে। বেদনারও মাধুরী আছে অধরা। আর এই অধরা মাধুরীর খোঁজে কবি ডুব দিয়েছেন একক জীবনের মারিয়ানা খাদে। তুলে আনছেন ‘বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম... ফল।’
জীবনের সবকিছুকে ছুঁড়ে ফুঁড়ে ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’ লাথি মেরে এক বিপন্ন আলোর খোঁজে শিবপুর বি। ই। কলেজের প্রথম বিভাগের প্রথম হওয়া মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডুব দিয়েছিলেন ‘নক্ষত্রের আলোয়’।
‘সাধ জাগে বড়ো সাধ জাগে ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলের নীচে এখনো রয়েছে কিনা কোনও অবশেষ।’
অবশেষ মানে ঘ্রাণ, বীজ, অঙ্কুরোদ্গম, প্রাণ, রক্ত, অস্থি মাংসের আত্মসমাহিত অনুভূতি। যেখানে দেখ আমাকে দেখ নামের কোন বিজ্ঞাপন নেই। আছে বাংলা কবিতার ঈশ্বর ও হয়ে ওঠার উপপাদ্য, গণিত ও সমাকল।

“আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাস্পের সহিত বাতাসের মতো নাই মেশো।
সেও এক অভিশাপ। অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি, কে জানে হয়ত অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে –
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতোন তোমাকেও
হয়তো পাই না আমি, পূর্ণিমার তিথিও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে।” ( ফিরে এসো চাকা )

বিজ্ঞানের প্রজ্জ্বলন আছে। সঙ্গে অপ্রাপণীয় প্রেমের সপ্রতিভ দানা। কেউ ছড়ায়। কেউ খেয়ে উড়ে যায়। আর ‘মাঝে মাঝে নক্ষত্র তো চাঁদ হয়ে পৃথিবীর কাছে এসে থাকে।’
না পাওয়া নারী, প্রেম, যৌনতার দিকে প্রবাহিত হতে থাকে তাঁর অঘ্রাণের অনুভূতি মালা।

অংশুমান একটু একটু করে বিনয়ের সত্ত্বাকে, তাঁর অনন্ত উপলব্ধির ভিতরে মোমের মতো জ্বলে ওঠা হৃদয়টিকে খুলে খুলে দেখাচ্ছেনগণিতের শরীরে অঘ্রাণের অনুভুতি, সংশ্লেষ, সুপ্ত যৌনবোধের অরূপ সমাহার ক্রমশ দুয়ার খুলে খুলে ছড়িয়ে পড়েছে ঈশ্বরীর সম্পূর্ণ সমর্পণে

আর দুই সময়ের দুই কবির কথোপকথনে ধরা পড়েছে পারস্পরিক সম্ভ্রমের নতুন উপপাদ্য,  মননের নতুন উন্মোচন
"— জীবনবাবু, একটি কথা জিজ্ঞেস করি। এই যে, আমি নিরন্তর আপনার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হই, এতে আপনি ক্ষুণ্ণ হন না তো? অসন্তুষ্ট হন না তো?
প্রতি কথায় গুরুর সঙ্গে যে শিষ্য সহমত হয়, সে আসলে প্রকৃত শিষ্যই নয়। আমার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হয়ে আপনি আমাকে নতুন চিন্তার খোরাক দিচ্ছেন। আমি বুঝেছি যে, আপনিই আমার প্রকৃত শিষ্য।”
“সেতু চুপে শুয়ে আছে, সেতু শুয়ে আছে তার ছায়ার উপরে।
ছায়া কেঁপে-কেঁপে ওঠে থেকে-থেকে জয়ী হওয়া সেতুর বাতাসে।
সকল সেতুর মতো এখানেও এই প্রান্তে কুসুম ফুটেছে;
সুন্দর সুঘ্রাণ ফুল, ও প্রান্তেও কুসুমের ঘ্রাণ ভেসে যায়।
ঘ্রাণ পাই, কুসুমের চারিপাশে পরিচিত পরাগকেশর;
যেন অন্য কোন দেশ, অন্য কোনো মহাকাশ ফুটে আছে যেন।” (অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)

সকাল। ২০০৬, ১১ ডিসেম্বর। বিছানা থেকে তুলে হাত-মুখ ধুয়ে দিলেন মাধবি। বারান্দায় চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন অশ্বিনীতারার কবি। সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিট। চলে গেলেন ছদ্মবেশী কবিতার দেবতা। ঝোলা পাতলুন, ফতুয়া পাঞ্জাবি পরে।

“বিনয় মজুমদার হতাশার, যন্ত্রণার, বিচ্ছেদের কবি। কিন্তু আশ্চর্য যে তিনি যদিও সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধুয়েছেন, তিনি বিষণ্ণ কিন্তু বিষাক্ত নন। তাঁর সর্বনাশের জন্য তিনি একটি নারীকে দায়ি মনে করেন। আমরা অবশ্য মনে করতে পারি যে আসল দুর্ভাগ্য তিনি কবি, এবং তিনি হয়তো অচেতনভাবে তাঁর এই সর্বনাশ কামনা করেছেন। কারণ, তাঁর দুঃখই তাঁর কবিতার একমাত্র উপকরণ। কিন্তু সেই নারীর প্রতি তাঁর কোনও অভিযোগ নেই।” ( জ্যোর্তিময় দত্ত )

অভিযোগ নেই, কারণ তিনি জানতেন –
‘হায় হাসি হায় দেবদারু
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়..

আর একটা কথা, উপন্যাসে অংশুমান যে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিনয়কে উপস্থাপন করেছেন সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত প্রচ্ছদে বিনয়ের তাপিত দৃষ্টির ছবি সেই একই মাত্রায় উচ্চারিত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

যোগাযোগ ও লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ spartakasmagazine@gmail.com