মন খারাপই তো
গড়ে তোলে সভ্যতা
ইট বার করা প্রাচীন
সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে নেমে গেছে জলে । ইটের ফাঁকে ফাঁকে বট অশ্বত্থের চারা। দুপাশে জংলা
গাছের ঝোপ ঝাড়ে আড়াল হওয়া। সময় এখানে এসে চুপ হয়ে গেছে। শুকনো পাতা উড়ে উড়ে এসে পড়ছে
নিঝুম ঘাটে। শেষ ধাপে গঙ্গার জল ছোট ছোট ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে, যেন
সেই সুদূর কাল থেকে জলের অবিরাম শব্দ আকাশের তারাদের মত প্রাচীন। মৃদু জ্যোৎস্নার আলো
কুচি কুচি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গঙ্গার বুকে। হালকা হাওয়ায় দুলছে গাছের পাতারা। এখানে, ঠিক
এই সিঁড়ির ধাপটাতেই সতেরো বছর আগে একদিন বসেছিল বিতস্তা। সেদিন বিতস্তাকে একটু অস্থির
লেগেছিল। এখানে এলেই নির্ঝরের মনটা হু হু করে ওঠে। সতেরো বছর আগের দিনটার সমস্ত খুঁটিনাটি
যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। নির্ঝর ভাবে বিতস্তা সেদিন কি কিছু বলতে চেয়েছিল! নির্ঝরও সেদিন
সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শব্দ আপ্রাণ চেষ্টা করেও গলা দিয়ে বার করতে পারেনি। নির্ঝরের আজও
জানা হয়নি - বিতস্তা সেদিন কিছু বলতে চেয়েছিল কিনা। আর তারপরই ঐ দিনের একটি মুহূর্ত
ঠিক করে দিল দুজনের বাকি জীবন। কালের যাত্রায়
দুজনের পৃথিবী দুদিকে চলে গেল। মাঝখানে ক্রমাগত ঢুকে পড়েছে কত মেঘ, আকাশ, পাখিদের উড়ে
যাওয়া।
কত শত মানুষের
কথা, সুখ-দুঃখ, সম্পর্ক, ভাঙা-গড়া; কত বন্যা, যুদ্ধ, নির্বাচন। তবু গঙ্গার ঘাটে যেন
এই সেদিনই ঘটেছিল সব। মাঝে মাঝে বেয়ারা হয়ে ওঠে নির্ঝরের মনটা। খুঁজে বের করার নেশা
বসে চেপে। তবু কালের যাত্রা আবার ভুলিয়ে দেয় সব। মাঝে মাঝে মনে হয় - দুঃখ দিয়ে
তৈরি যেটুকু নিটোল হয়ে বেঁচে আছে, সেটা ভেঙ্গে না যায়। তার চেয়ে থাক। এই মনখারাপটুকুই
বেঁচে থাক। এযে তার একান্তে আপন মনের নিভৃত সঙ্গী। বেঁচে থাকার জন্য এ যে তার সম্পদ।
তা না হলে যদি দেখে বিতস্তা ঘোর সংসারী আর সেদিনের অতীত আজ তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে!
তখন যে ঘাটের সেই নিভৃত বিতস্তা খুন হয়ে যাবে আজকের বিতস্তার কাছে। দূরত্বের মধ্যেই
যে কাছে পাওয়া। মনখারাপের মধ্যেই তো সান্নিধ্যের তৃপ্তি, আকাঙ্ক্ষার পথচলা চিরকাল।
যেমন করে বেঁচে থাকে প্রতিটি সূর্যাস্তে আলোর সাথে পৃথিবীর মাটির বিচ্ছেদ; বেঁচে থাকে
ঘাসের ডগায় ডগায়, গাছের প্রান্ত থেকে গোধূলির শেষ আলোটুকুর চলে যাবার কষ্ট; ডাল থেকে
ফুল পাতা খসে পড়ার কান্না। কিছু ধরে রাখা যায় না। তবু বাঁচতে হয় হারিয়ে হারিয়ে।
তাই হয়তো যন্ত্রণা আর কষ্টগুলো, দুঃখ আর হাহাকারগুলো কালের ঢেউ পেরিয়ে দেখা দেয় মধুর
মন খারাপ হয়ে, বসন্তের মৃদু বাতাসের মতো। তখন যে মনখারাপ করতে ইচ্ছে করে খুব! হয়তো
তাই মন খারাপ করা বিকেল নেমে আসে সূর্যাস্তের মুখে, রাস্তায় রাস্তায়, দেয়ালের, কার্নিশে,
চিলেকোঠায় চিরকালের চলে যাবার বার্তা নিয়ে। তাইতো সেদিন কে যেন বলছিল - সন্ধ্যে নেমে
এলে আমার কেন মনখারাপ করে, আজও বুঝিনা। আলো একটু একটু করে সরে যেতে থাকে, মাটির ওপর
ছায়াগুলো দীর্ঘতর হয়। গাছের ডালে, ইলেক্ট্রিকের তারে ফিরে এলে পাখিদের কিচিরমিচির
- আমাদের মনখারাপ করে কেন জানিনা। গভীর মর্মস্থলে
কিসের ভাষা পৌঁছে যায় তখন? বিদায়ের? বিদায়ের মুহূর্ত আমরা বারবার মনে করতে
চাই কেন? বিদায়ের মধ্যে তীব্রভাবে পাওয়া, তাই? মনখারাপের মধ্যে পাওয়ার আনন্দ, যে পাওয়া
সুদূর কালের? এখনও বাংলার ঘরে ঘরে বাবারা হারিয়ে যাওয়া মেয়ের শেষ চিঠি পায়-
"অবলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,
তাতে লেখা-
'তোমাকে দেখতে বড্ডো
ইচ্ছে করছে’।
আর কিছুই নেই।" (শেষ চিঠি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সব সময় ছড়িয়ে
আছে স্মৃতি- "চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল/ এসেন্সের শিশি,/ শেলফে তার পড়ার বই/ ছোট
হারমোনিয়াম।" সব পড়ে আছে, শুধু মেয়ে
অমলা নেই। তখন যা ছিল যন্ত্রনা, আর্তনাদ, কাতরতা- কালের যাত্রায় পৃথিবীর সমস্ত বাবার
বুকে তাই হয়ে ওঠে মেয়ের জন্য মধুর মনখারাপ। কবিতাটি আমরা বারে বারে পড়ি। বারে বারে
ফিরে যাই মন খারাপের কাছে। আবার পড়ি। মনখারাপের মধ্যে অন্য এক আনন্দ। যেমন করে এখনও
মনখারাপ করে মহেঞ্জোদারোর ডালে বসে হারিয়ে যাওয়া কোন পাখির ডাক শুনতে পেলে। এমনি
করেই যে মনখারাপ ধরে থাকে সুদূরের সাথে আর এক সুদূরকে। লক্ষ কোটি মন খারাপ এভাবেই গড়ে
তোলে সভ্যতা।
No comments:
Post a Comment